1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

খেলোয়াড়রা দায়িত্ব পালন করলেন, কর্তারা?

১২ ডিসেম্বর ২০১৬

একটা ম্যাচে দলের স্কোর ৭ উইকেটে ৭৫৷ বিদেশি ভাষ্যকার চেঁচিয়ে বলছেন, ‘‘দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থা৷ টিভি থেকে চোখ সরাবেন না৷''

https://p.dw.com/p/2U7x5
বিপিএল
ছবি: Mir Farid

শুনে টিভিতে গভীরভাবে চোখ রাখলাম৷ ঠিক কী হচ্ছে? এমন কিছু কি ঘটছে যা ভাষ্যকার দেখছেন আর কেউ দেখছে না? না, তা তো নয়৷ ৭৫ রানে ৭ উইকেট পড়ে গেছে, যার অর্থ খুবই লো স্কোরিং একটা ইনিংস হচ্ছে৷ এরপরও নাটকীয় কিছু ঘটতে পারে, কিন্তু সেটা তো দূরবর্তী সম্ভাবনা৷ তা নিয়ে তো লাফালাফি করা যায় না৷ তাহলে ভাষ্যকারের এই উত্তেজনা কেন? সেটা বুঝতে একটু দেরি হওয়ার জন্য পরে নিজেকেই ভর্ৎসনা করতে ইচ্ছে হয়৷ এখানে ভাষ্যকাররা তো আসলে ক্রিকেট ভাষ্যকার নন, তাঁরা হচ্ছেন সার্কাস মাস্টারের মতো৷ মানুষকে ধরে রাখার জন্য যা যা বলার তাই বলতে হয়, স্রেফ ক্রিকেটীয় জায়গা থেকে যদি বলেন এটা একপেশে ম্যাচ হবে তাহলে ম্যাচ একপেশে-দুইপেশে যাই হোক তাঁর চাকরিটা খুব সম্ভব চলে যাবে৷ চাকরি বাঁচাতে ওরা প্রায় ভাঁড়৷ ইদানীং শুধু কথায় কাজ হচ্ছে না বলে তাঁদের কেউ কেউ শারীরিক কসরতও করেন দেখি৷

এবারের বিপিএল-এ বেচারাদের এই কাজটা একটু বেশি হয়েছে৷ কারণ বেশিরভাগ ম্যাচই হয়েছে লো স্কোরিং৷ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটা আবিষ্কৃতই হয়েছে রান বন্যার জন্য৷ চার-ছয়ের মারে রানের পাহাড় হবে, আরেক দল সেটা পেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করবে৷ পারলে দারুণ, না পারলেও কাছাকাছি যাওয়ার পথে ওরাও ব্যাটিং শৌর্য দেখাবে, এটাই এই ক্রিকেটের কাছে দাবি৷ এবারের বিপিএল সেই দাবি মেটাতে মোটামুটি ব্যর্থ৷ এই প্রশ্ন উঠলে সেই ভাষ্যকাররা কিংবা বিপিএল প্রশাসনের লোকজন পাল্টা যুক্তি দেখিয়েছেন, ‘‘লো স্কোরিং হলেও ম্যাচগুলো তো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে৷ মানুষ তো প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখতে চায়৷''

কথা ঠিক৷ বেশ কয়েকটা ম্যাচ খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে৷ লো স্কোর করেও কোনো কোনো দল অবিশ্বাস্যভাবে জিতে গেছে৷ কিন্তু শেষপর্যন্ত এটা ভীষণ কুযুক্তি৷ দুটো দল যদি খুব বাজে খেলে তাহলে যে কোনো ম্যাচই খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে কিন্তু সেটা কি কেউ দেখতে চায়? প্রতিদ্বন্দ্বিতার উত্তেজনা হচ্ছে সেটা যখন নৈপুণ্যের সর্বোচ্চ সীমায় থাকবে দুই দল এবং সেই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই হবে৷ দুটো দল ব্যর্থ হয়ে এক জায়গায় চলে এলে যে সমতা প্রতিষ্ঠিত হয় তা দেখে যদি কেউ তাকে লড়াই ভাবে তাহলে বুঝতে হবে খেলা-লড়াই-উত্তেজনা এ সবের আদর্শ সংজ্ঞা নিয়েই তার ধারণাটা অস্পষ্ট৷

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটা আবিষ্কৃতই হয়েছে ব্যাটিং শক্তির সর্বোচ্চ সীমানাটা জানার জন্য৷ টি-টোয়েন্টি হওয়ার পর তাই আমাদের দেখার বিষয় সর্বোচ্চ কোন জায়গা পর্যন্ত ব্যাটিং পৌঁছাতে পারে৷ সর্বোচ্চ ২৬৩ রান পর্যন্ত দেখা গেছে এবং যেভাবে খেলাটা আগাচ্ছে তাতে ৩০০ রান দেখতে বোধহয় বেশিদিন অপেক্ষা করা লাগবে না৷ আক্রমণাত্বক ব্যাটিংয়ের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেখার জন্য যে ক্রিকেট, সেখানে লো স্কোরিং ম্যাচ তার চরিত্র এবং উদ্দেশ্যের সঙ্গেই বেমানান৷ লো স্কোরিং-প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ তো টেস্ট আর ওয়ানডেই উপহার দিতে পারে, তাহলে টি-টোয়েন্টির আর দরকার কী ছিল! অবাক ব্যাপার, টি-টোয়েন্টির এই চাহিদা জানা সত্ত্বেও এবার কেন এমন উইকেট তৈরি হল, যেখানে রান হয় না? তার মানে প্রশাসকরা আসলে নাচ-গান, বাইরের বিষয় নিয়ে এমন মত্ত থাকেন যে মাঠের ক্রিকেটের ন্যূনতম চাহিদাটা মেটানোর সময়ও হয় না৷ টি-টোয়েন্টি অনুপযোগী উইকেট তৈরি করে লো স্কোরিং ম্যাচের মেলা বসিয়ে আরেকবার নিজেদের অমনযোগিতাটা দেখালেন ক্রিকেট কর্তারা৷

মোস্তফা মামুন
মোস্তফা মামুন, উপ-সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠছবি: MIRFARID

লো স্কোরিং ম্যাচ, ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ, অক্রিকেটীয় উৎসব এসবের ভিড়েও এই বিপিএল-এ নতুন যা ইতিবাচক দিক তা আমাদের শীর্ষ ক্রিকেটারদের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স৷ প্রথম তিনটি বিপিএল এর তুলনায় এবার আমাদের তারকারা অনেক সফল৷ অসাধারণ ধারাবাহিক মাহমুদউল্লাহ, তামিম৷ মুশফিকও পিছিয়ে নন খুব একটা৷ মাশরাফি-সাকিব তাঁদের কাছে প্রত্যাশার তুলনায় পিছিয়ে থাকলেও খুব খারাপ করেছেন বলা যাবে না৷ এর বাইরে সাব্বির-শাহরিয়ার, নাফীসদের পারফরম্যান্সও বলার মতো৷ মোহাম্মদ শহীদ-শফিউল ইনজুরির আগে দারুণ বল করেছেন, রুবেল-তাসকিন ওদের মতো অত ধারাবাহিক না হলেও পারফরম করেছেন৷ এই সাফল্যের কারণ৷ এটা মানতেই হবে যে খুব উঁচুমানের বিদেশি খেলোয়াড় এবার খুব বেশি ছিলেন না, তাই ওদের কাজটা তুলনামুলক সহজ ছিল৷ কিন্তু মূল বিষয়, বোধহয় আমাদের তারকা ক্রিকেটাররা এতদিনে নিজেদের ওজনটা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন৷ আইকন সূত্রে তাঁদের উপর যে দায়িত্বশীলতা সেটা নেয়ার মতো পরিপক্কতাও তৈরি হয়েছে৷ তারকা খেলোয়াড়রা এমন ভালো করায় নতুনদের সুযোগ কমে গেছে৷ কেউ কেউ অবশ্য মেহেদী মারুফের কথা বলবেন৷ কিন্তু মেহেদী যে সাকিবদের সময়ের খেলোয়াড় এটাও মোটামুটি সবার এখন জানা হয়ে গেছে৷ এছাড়া ফরহাদ রেজা, নাজমুল অপু বা এরকম আরও যারা পারফরম করেছেন এরাও পুরনো খেলোয়াড়৷ আসলে বিপিএল-এ দল মাত্র ৭টা হওয়াতে এবং প্রতি দলে চারজন বিদেশি হওয়াতে বাংলাদেশের মাত্র ৫০ জন ক্রিকেটার সুযোগ পেয়েছেন৷ এর মধ্যে প্রায় ২৫-৩০ জন খেলোয়াড় আছেন যাঁরা জাতীয় দলে খেলেছেন বা খেলছেন৷ ফলে জাতীয় দল সীমানার বাইরের মাত্র ১৫-২০ জনে বিপিএল খেলার সুযোগ রয়েছে৷ দেখা যায়, সেই তাদের ক্ষেত্রেও দলগুলো ভরসা করে ঘরোয়া ক্রিকেটে দীর্ঘদিন ধরে খেলা স্থানীয়দের উপর৷ একেবারে নতুন বললে বলতে হবে, রাজশাহীর আফিফের কথা৷ সেটা দেখে বরং আফসোস হলো আরেকটু৷ যদি এরকম নিয়ম হতো প্রত্যেক দলে এক বা দুজন নতুন খেলোয়াড় বাধ্যতামূলক খেলাতে হবে তাহলে হয়ত ওর মতো আরও দুয়েকজন তরুণ সুযোগটা কাজে লাগাতে পারত৷ আইপিএল-এও শুরুতে যেটা ছিল৷ এমনকি যে ইউরোপিয়ান ফুটবল জায়ান্টরা পারলে অন্য দেশের খেলোয়াড় দিয়ে একাদশ ভরে দেয় সেখানেও স্থানীয় খেলোয়াড় নেয়ার কিছু বাধ্যবাধকতা আছে৷ এখানে নেই৷

এই বাধ্যবাধকতাটুকু দরকার আরেকটা কারণেও৷ আইপিএল এর কথাই যদি ধরি সেটা একই নিয়মে চললেও হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে খেলা বলে স্থানীয় দর্শকদের সঙ্গে নিজেদের দলের একটা যোগাযোগ তৈরি হয়৷ দ্বিতীয়ত, দলগুলো তাদের ক্যাম্প করে নিজেদের শহরে, সেখানে প্র্যাকটিস হয়৷ আমাদের এখানে সবার ক্যাম্প ঢাকায়, প্র্যাকটিস ঢাকায়৷ খেলাও ঢাকা আর চট্টগ্রামে৷ ফলে খুলনা দলের সঙ্গে সত্যিকার অর্থে খুলনা বিভাগের সেই অর্থে কোনো সম্পর্কই নেই৷ নামটা তাই এক ধরণের আরোপিত, শুধুমাত্র টুর্নামেন্ট জমাতে আঞ্চলিক আবেগ ব্যবহারের একটা ক্ষেত্র৷ মুখে যে যাই বলুন আমাদের যা বাস্তবতা তাতে আগামী কয়েক আসরেও সবগুলো ভেন্যুতে খেলা নিয়ে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ের সুযোগ নেই৷ স্থানীয় সংযুক্তির জন্য তাই বিকল্প হিসাবে এই ব্যবস্থা হতে পারে যে প্রতি বছর প্রতিটা ফ্র্যাঞ্চাইজি অন্তত এক বা দুজন স্থানীয় তরুণ নিতে বাধ্য থাকবে৷ হতে পারে বিভাগে উন্মুক্ত ট্রায়ালের মাধ্যমে সেরা খেলোয়াড়কে বেছে নেয়ার ব্যবস্থা৷ তাতে দুটো লাভ, দলের প্রতি স্থানীয়দের মালিকানার একটা সূত্র তৈরি হবে৷ আর সেরকম সুযোগ কাজে লাগিয়ে মিলে যেতে পারে সত্যিকারের কোনো সম্পদ৷ তখন আর বিপিএল কর্তারা শাক দিয়ে মাছ না ঢেকে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন, ‘‘অমুক আমাদের বিপিএল এর তৈরি৷''

চার মৌসুম বিপিএল দেখে দেখে অবশ্য এসবকে এখন অরণ্যে রোদন মনে হয়৷ এসব কিছুই হবে না৷ বিপিএল চলবে বিপিএল-এর নিয়মে৷ কর্তাদের অদ্ভুতুড়ে অংক মেনেই৷

আশার কথা যে, দেশের ক্রিকেটারদের বেশিরভাগ তাদের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছেন না৷ শীর্ষ তারকাদের প্রায় সবাই এবার ছিলেন কোনো না কোনো দলের অধিনায়ক এবং অসাধারণ দায়িত্ববোধ নিয়ে টেনেছেন নিজেদের দলকে৷ ভাষ্যকাররা ম্যাচ জমাতে যাই বলুন আমরা জানি এবারের বিপিএল এর প্রাপ্তির স্লোগান এটাই- সিনিয়র ক্রিকেটারদের দায়িত্বশীলতা এবং ধারাবাহিকতা৷

আর সামগ্রিক বিপিএল এর ক্ষেত্রে স্লোগানটা হওয়া উচিত এরকম – ক্রিকেটাররা তাঁদের দায়িত্ব পালন করলেন, প্রশাসকরা নন৷

মোস্তফা মামুন, উপ-সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ

বন্ধু, মোস্তফা মামুনের এই লেখাটা কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য