‘ঝড়-তুফান হলে বাঁচার রাস্তা আজও নেই'
২৪ এপ্রিল ২০১৮ডয়চে ভেলে: অনেক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস আপনি দেখেছেন৷ সে সম্পর্কে যদি কিছু বলেন...
রবিউল আলম: উড়িরচরে ১৯৮৫ সালের বন্যায় ৫ থেকে ৭ হাজার লোক মারা যায়৷ সে সময় ভিটেমাটি সমান হয়ে গিয়েছিল৷ ১৯৮৮ সালের বন্যায়ও সামান্য ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল৷ এরপর ১৯৯১ সালের বন্যায়ও একইরকম৷ কোনো লতাপাতাও ছিল না৷ এখনো যদি কোনো বন্যা হয় তাহলে মানুষের বাঁচার মতো কোনো রাস্তা নেই৷ এখন গাছগাছালি হয়েছে অনেক৷ এখানে কোনো বেড়িবাঁধ নেই, কোনো বিল্ডিং নেই৷ যদি ১০-২০ ফুট পানি হয় তাহলে কেউ বাঁচবে না৷ এখানে সরকারি কোনো সহযোগিতা নেই৷ আমাদের চারপাশে নদী, মাঝখানে আমাদের দ্বীপ৷ এটা সন্দ্বীপ উপজেলার মধ্যে পড়ে৷ আমাদের এখানে স্কুল-কলেজও উন্নত হয়নি৷ আমরা নিজ খরচে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি৷ সেখানে ছেলে-মেয়েরা ৪ থেকে ৮ কিলোমিটার দূর থেকে আসে৷ ফলে তাদের অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কাও আছে৷
আপনাদের ওখানে কোন ধরনের ঝড় বেশি হয়?
এখানে কালবৈশাখী কম হয়৷ কিন্তু কার্তিক মাস মানেই বন্যা হয় ভয়াবহ৷ ১৯৮৫ সালের বন্যাটা কিন্তু জ্যৈষ্ঠ মাসে হয়েছিল৷ দু'বছর আগেও জ্যৈষ্ঠ মাসে জোয়ারের বন্যা হয়েছিল, তবে সেটা ভয়াবহ হয়নি৷ তখন বেশ কিছু গবাদিপশু নষ্ট হয়েছে৷ আবার যদি বন্যা হয় তাহলে গবাদিপশু কিছুই থাকবে না৷ গবাদিপশু বলতে হাস-মুরগি বেশি নষ্ট হয়৷
সব কিছু হারিয়ে আপনারা কীভাবে ঘুরে দাঁড়ান?
নিজেরা কাজ করি৷ আর কিছু সহযোগিতা পাই৷ ১৯৮৫ সালের বন্যার পর ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব কিছু সহযোগিতা করেছিল৷ তখন এখানে ১১ ফুট উঁচু একটি বিল্ডিং করেছিল, সেটা নদীর ভাঙনে ভেঙে যায়৷ এখন এখানে সরকারি তহবিল থেকে জনগণকে বাঁচানোর জন্য কিছু করা হয়নি৷
ওখানে কি কোনো সাইক্লোন সেন্টার আছে?
এখন এখানে চারটি সাইক্লোন সেন্টার আছে৷ তবে সেগুলো ৬ থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে৷ যেখানে জনবসতি, সেখানে সাইক্লোন সেন্টার হয়নি৷
এই সাইক্লোন সেন্টারগুলো কি নিরাপদ?
হ্যাঁ, এগুলো নিরাপদ৷ কিন্তু ঝড় উঠলে সেখানে পৌঁছানোই কঠিন৷ কারণ ওগুলো তো অনেক দূরে৷
সাইক্লোন সেন্টারগুলো আসলে কত দূরে?
এই দ্বীপে জনবসতি মাঝখানে৷ কিন্তু সাইক্লোন সেন্টারগুলো অনেক দূরে৷ একটা ৩ কিলোমিটার, একটা ৪, একটা ৬ এবং একটা ৭ কিলোমিটার দূরে৷ বর্তমানে চরের ম্যাপ অনুযায়ী আমরা মাঝখানে আছি৷
রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ-সুবিধা কি আপনারা পান?
গত বছর আমরা সরকারের কাছ থেকে রিলিফে কিছু চাল পেয়েছি৷ তাতে বয়স্ক ভাতাও সম্পূর্ণ হয়নি৷ কিছু লোকে পায়, কিছু লোকে পায় না৷
এই দ্বীপটাতে কত মানুষ বাস করেন?
এখানে এখন ২০ হাজারের বেশি মানুষ বাস করেন৷
এখানে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা কেমন?
এখানে সরকারিভাবে তেমন কোনো স্বাস্থ্যসেবা নেই৷ একটা মেডিকেল টিম আছে৷ তাতে একজন এমবিবিএস ডাক্তার আছেন৷ তিনি মাসে তিন দিন থাকেন৷
এখানে শিক্ষাব্যবস্থা কেমন?
এখানে পাঁচটি প্রাইমারি স্কুল আছে৷ তবে ছাত্র কম৷ আমার ওখানে একটা স্কুল আছে, যেখানে পাঁচজন শিক্ষক থাকার কথা৷ আছে তিনজন৷ অন্য দু'জনের চেহারাও আমরা কোনোদিন দেখিনি৷
১৯৮৫ সালের বন্যায় আপনি কী হারিয়েছেন?
আমার ভাইয়ের বউ মারা গেছে৷ তার তিন সন্তানও মারা গেছে৷ এছাড়া আমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বেশি কেউ মারা যায়নি৷ তবে এলাকার অনেক মানুষ মারা গেছে৷
সেখান থেকে আজকে এখানে পৌঁছালেন কীভাবে?
তখন তো অনেক মানুষ মারা গেছে৷ তাদের দাফন করেছি৷ অনেক মানুষ মাটিও পায়নি৷
এখানে কোনো এনজিও কাজ করে?
তখন কারিতাস সংস্থা তিন ফিট করে কিছু ঘর দিয়েছিল৷ ১৯৯৬ সালে এখানে একটা বিল্ডিং হয়৷ গত পাঁচবছর ধরে ওই বিল্ডিংয়ে উঠতে ভয় লাগে৷ ওটা সাইক্লোন সেন্টার ছিল৷ এখন সেটা স্কুল হয়ে গেছে৷
এনজিওগুলো কি কোনো সহায়তা করে নাকি শুধুই ঋণ দেয়?
এখানে কিছু মহিলা সমিতি করেছে৷ সেই মহিলা সমিতির মাধ্যমে ঋণ দেয়া হয়৷ অন্য ঋণের কোনো ব্যবস্থা নেই৷
আপনাদের জীবন-জীবিকা চলে কীভাবে?
আমাদের প্রধান কাজ কৃষি৷ এছাড়া চারপাশে নদী আছে৷ তাই অনেকে মাছ ধরে বিক্রি করে৷ আর গবাদি পশু আছে৷ ভেড়া, ছাগল, গরু, মোষ পালে অনেকে৷
ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় গবাদি পশু নিয়ে কী করেন?
রেডক্রসের চারটি কিল্লা আছে৷ আর নিজেরা বেশ কিছু কিল্লা বানিয়েছি৷ সেগুলোতে গবাদি পশু রাখি৷
এই কিল্লা কী?
এখানে কয়েক ফুট উঁচু করে মাটি দিয়ে পাহাড়ের মতো বানানো হয়৷ সেখানে গবাদি পশু রাখার ব্যবস্থা করা হয়৷ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে কিল্লা ভাঙে না৷ এটা ১০ থেকে ১৫ ফুট উঁচু হয়৷ অনেকে নিজেই কিল্লা বানিয়েছে৷
ঝড়-তুফানের আগাম কোনো বার্তা আপনারা পান?
আমরা টিভির মাধ্যমে জানতে পারি৷ এখানে ছয়টা বড় বাজার আছে৷ সেখানে অনেক দোকানে টিভি আছে৷ সেই টিভি দেখেই আমরা জানতে পারি৷
আপনাদের ওখানে কি প্রতিবছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়?
প্রতিবছর হয় না৷ তবে প্রতিবছর বর্ষাকালে পানি উঠে৷ স্বাভাবিক জোয়ারেও ২ থেকে ৩ ফুট পানি উঠে৷ তবে সেই পানি ঘরে ঢোকে না৷
ওখানে লেখাপড়া করে কেউ উচ্চশিক্ষিত হয়েছে?
এখানে এমএ, বিএসসি, বিএড পাস করা অনেক ছেলে আছে৷
সরকার থেকে আপনারা কি নিয়মিত কোনো টাকা পান?
দুর্যোগের পর অল্প কিছু চাউল, কম্বল এগুলোই যা পাই৷
আপনাদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কে?
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান৷
তিনি কি আপনাদের খোঁজ নেন?
এখানে ১৫ বছর ধরে কোনো নির্বাচন হয় না৷ এখানে যিনি চেয়ারম্যান ছিলেন, সন্ত্রাসীরা তাঁকে মেরে ফেলেছিল৷ এরপর একজন মেম্বারকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে৷
তিনি কি আপনাদের কোনো সহযোগিতা করেন?
খুবই সামান্য৷ এখানে ২০ হাজার মানুষ আছে৷ হয়ত এক-দেড় হাজার লোকের সহযোগিতা হয়৷
এই ঝড়-তুফান থেকে বাঁচার জন্য আপনাদের কোনো প্রশিক্ষণ আছে?
না, কোনো ধরনের কোনো প্রশিক্ষণ নেই৷
সচেতনতামূলক কোনো কাজ কি হয়? মানে এই ধরনের পরিস্থিতিতে আপনারা কী করেন?
এমন কিছু হয় না৷ তবে এখন ‘মাইকিং' করা হয়৷ সবাইকে আগেই বিষয়টা জানিয়ে দেয়া হয়৷
আপনার মতো যাঁরা উপকূলীয় এলাকায় বাস করেন, তাঁদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
আমি মনে করি, সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে সরকারকে জানাতে হবে যে আমরা এটা পাচ্ছি না, ওটা পাচ্ছি না৷ অনেক কিছুই সরকার দিচ্ছে৷ কিন্তু আমরা সেসব পাচ্ছি না কেন? এখন যারা তরুণ তারা শিক্ষিত হচ্ছে৷ আগের যারা তাদের তো শিক্ষা ছিল না৷ তাই তারা অনেককিছুই জানত না৷ এখন ১৮ থেকে ২০ বছর বয়স যাদের, তারা সবকিছুই জানে, বোঝে৷
ঝড়-তুফান থেকে উপকূলের মানুষদের রক্ষা করতে বাংলাদেশের কতটা প্রস্তুতি আছে বলে মনে হয়? মন্তব্যের ঘরে লিখুন৷