চারুকলা প্রদর্শনী
৩ অক্টোবর ২০১৩একটি সবুজ বল বারবার আঘাত করছে একটা কংক্রিটের দেয়ালে৷ প্রদর্শনীর প্রবেশ পথেই রাখা তুর্কি শিল্পী আইসে এর্কমেনের এই ‘ইন্সটেলেশন আর্ট’-টি, যা দর্শকদের স্বাগত জানাচ্ছে এক বিশালাকার ধ্বংসস্তূপের প্রতীক হিসেবে৷ এ বছর বিয়েনালের কিউরেটর ফুলইয়া এরডেমচির মতে, শিল্পকলার মাধ্যমে নিপীড়িত ও সমাজবহির্ভূতদের তুলে ধরাই এই প্রদর্শনীর মূল লক্ষ্য৷ বলা বাহুল্য, তুর্কি সমাজে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ এবং সহাবস্থান শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরেও নানা ধরণের প্রবাভ বিস্তার করেছে৷ তাই তো, এবারের মূল বিষয় বা ‘মটো'– ‘মা আমি কি বর্বর?'
গত প্রায় দু'বছর যাবৎ ইস্তানবুলের বেশ কিছু উন্মুক্ত এলাকা যেমন গেজি পার্ক, তাকসিম চত্বরের মতো জায়গাগুলি ভেঙে ফেলা হবে বলে হুমকি দেয় তুর্কি সরকার৷ তাই সেই অঞ্চলে প্রায় ৮৮ জন আন্তর্জাতিক শিল্পীর শিল্পকর্ম প্রদর্শনের যে পরিকল্পনা ছিল, তা বাতিল করতে বাধ্য হন এরডেমচি৷ নগর পৌরসভা ও সংস্কৃতি দপ্তরে আবেদন করেও তিনি কোনো উত্তর পান না৷ পরবর্তীতে এ সমস্ত এলাকা ধ্বংস করার বিরুদ্ধে তুরস্কের জনগণই দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ জানায়৷ কিন্তু সরকার তা কঠোর হাতে দমন করার চেষ্টা করে৷
এহেন দমনপীড়নের প্রতিক্রিয়া শুধু ইস্তানবুলেই নয়, ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে৷ গেজি পার্ককে ভেঙে সরকার যখন একটি বহুতল ‘মল' নির্মাণের অনুমতি দেয়, তখন তার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে জনতা৷ এ ঘটনা বহু দূর গড়ায়৷ ফুলইয়া এরডেমচি অবশ্য উন্মুক্ত এলাকা ছেড়ে শহরের ভিতরে পাঁচ কক্ষের একটি প্রদর্শনী হলে ফিরে আসেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমরা কোনোভাবেই সেই সমস্ত কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করতে চাইনি যারা এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন, জনতার কণ্ঠ রোধ করতে চায়৷''
এবার বিয়েনালের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক শিল্পীরা এই প্রতিবাদের সাথে জড়িত হতে চান৷ জার্মান শিল্পী ক্রিস্টফ শ্যেফার তাঁদেরই একজন৷ রাজনৈতিক ফোরাম হিসেবে পার্কের গুরুত্ব প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর অঙ্কনচিত্রে৷ হামবুর্গের একটি পার্ক নিয়ে তাঁর একটি ছবি রয়েছে৷ উন্মুক্ত জায়গায়, মাঠে, রাস্তায় বা কফি শপে মানুষের মধ্যে যে আদান-প্রদান হয়, তাতে রাজনৈতিক নানা ভাবনারও আত্মপ্রকাশ ঘটে৷ স্বাভাবিকভাবেই তুরস্কের বর্তমান সরকার সেটা চায় না৷
ক্রিস্টফ শ্যেফার ১৫ বছর আগে নিজেই ‘পার্ক ফিকশন'-এর জন্য কাজ করেছেন৷ হামবুর্গ শহরের এই পার্কটি একটি শিল্পসম্মত সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রকল্প, যাতে তিনি শিল্পী হিসেবে জড়িত ছিলেন৷ সেখানকার বসিন্দারা এই পার্ক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তাঁদের মতামত দিয়েছেন, নকশা এঁকেছেন৷ একাত্মতা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যেই রাতারাতি এই পার্কের নতুন নামকরণ হয় ‘গেজি পার্ক ফিকশন'৷ শ্যেফারের ভাষায়, মানুষের মধ্যে, রাষ্ট্রের মধ্যে যে বর্বরতা আছে, সেটা বিয়েনালেতে তুলে ধরাটা ‘নাগরিক অবাধ্যতা' নয়, বরং এটি ইস্তানবুলে ঘটে চলা বিভিন্ন ঘটনাবলীর একটি প্রতিফলন৷
তুর্কি শিল্পী ও কোরিওগ্রাফার অ্যার্ডেম গ্যুন্ডুজ-ও বিয়েনালে অংশগ্রহণকারী একজন শিল্পী৷ গ্রীষ্মে প্রতিবাদী জনতার উদ্দেশ্যে তিনি একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন৷ তাকসিম চত্তরে নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিবাদ করেন তিনি৷ প্রতীকী এই প্রতিবাদের নাম দেন ‘দাঁড়ানো মানুষ'৷ সে সময় হাজার হাজার মানুষ যোগ দেন তাঁর সাথে৷ ঘণ্টার পর ঘণ্টা নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি খোলা আকাশের নীচে, যা ছিল বিক্ষোভের একটি সৃজনশীল বিকল্প৷
বিয়েনালের সহ কিউরেটর আন্দ্রেয়া ফিলিপ্সের জন্য, গেজি পার্কের পাশাপাশি আর্থিক সংকটও প্রদর্শনীর একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়৷ কারণ এই শহরের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিই ইস্তানবুলকে আকর্ষণীয় করে তোলে৷ কিন্তু ইস্তানবুলে এখনও পুঁজিবাদ নিয়ে সমস্যা রয়ে গেছে বলে মনে করেন ফিলিপ্স৷
আলোকচিত্রশিল্পী সের্কান তাইচান ইস্তানবুলের বিতর্কিত নির্মাণগুলি ধ্বংস করার বিষয়টির প্রতি দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন৷ প্রদর্শনীতে আসা এক তরুণী বলেন, ‘‘তুরস্কে যাঁরা বাস করেন তাঁদের জন্য এটা একটি কঠিন সময়৷ আমরা আনন্দিত যে শিল্পীরা মানবাধিকার এবং সেই সাথে অর্থনৈতিক নিষয়গুলি নিয়েও কাজ করছেন৷''
বিয়েনালে শেষ হবে ২০ অক্টোবর৷ কিন্তু দর্শকদের প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যেই লক্ষণীয়৷ দর্শকদের মনোযোগ খুব গভীর যা অন্য প্রদর্শনীতে লক্ষ্য করা যায় না৷ শুধু এই বিয়েনালে দেখার উদ্দেশ্যেই সুইডেন থেকে ইস্তানবুল এসেছেন এক দর্শক৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমি রাজনৈতিক শিল্প সম্পর্কে খুব একটা আগ্রহী নই, কিন্তু আমি ইতিমধ্যেই অনেক বিয়েনালে ঘুরে দেখেছি, ভনিসেও গেছি৷ কিন্তু এমন একটা আকর্ষণীয় প্রদর্শনী আমাকে বিষ্মিত করেছে৷''