আউশভিৎস বন্দি শিবিরের মুক্তির ৬৫ বছর পূর্তি
২৭ জানুয়ারি ২০১০গণহত্যার কারখানা
আউশভিৎস – নামটি মানবজাতির ইতিহাসের এক ভয়াবহ কলঙ্কের সঙ্গে জড়িত৷ পোল্যান্ডের এই এলাকায়ই হিটলারের নাৎসি ক্ষমতাযন্ত্র গড়ে তুলেছিল গণহত্যার এক কারখানা৷ ইহুদি – ও নাৎসিদের দৃষ্টিতে সমাজের অন্যান্য ‘অপ্রয়োজনীয়' মানুষকে সেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে এনে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হত৷ ধর্ম, বর্ণ, মতাদর্শ, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা – এমন কত কারণেই মানুষকে এই বিকৃত ও নৃশংস নিধন প্রক্রিয়ার শিকার হতে হয়েছে৷ ইহুদি নিধন যজ্ঞের আরও কিছু অকুস্থল থাকলেও আউশভিৎসই এই জঘন্য অপরাধের প্রতীক হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে৷ ১৯৪৫ সালের ২৭শে জানুয়ারি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের রেড আর্মির সেনারা অবশেষে ঐ হত্যা শিবির বন্ধ করে৷ তার আগে পর্যন্ত সেখানে ১০ লক্ষেরও বেশী মানুষকে হত্যা করা হয়েছে৷
সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড
জার্মান জাতির নামে হিটলারের নাৎসি প্রশাসন যে মাত্রায় হত্যালীলা চালিয়েছিল, ইতিহাসে তার কোন তুলনা নেই৷ পোল্যান্ড সহ যেসব দেশ নাৎসিদের দখলে চলে এসেছিল, সেই সব দেশ – এবং অবশ্যই খোদ জার্মানি থেকে নিরপরাধ মানুষদের মালগাড়িতে করে গবাদি পশুর মত আনা হত আউশভিৎস সহ অন্যান্য নিধন শিবিরে৷ সংখ্যায় ইহুদিরাই বেশী হলেও তাদের সঙ্গে নাৎসিদের রোষের শিকার হতে হয়েছে অনেক রাজনৈতিক বন্দি, অসুস্থ, সমকামী ইত্যাদি মানুষকে৷ আউশভিৎস শিবিরের বাইরের ফটকের উপরে টাঙানো ছিল এক বোর্ড – তাতে লেখা ‘আর্বাইট মাখট ফ্রাই' – অর্থাৎ ‘কর্মের মাধ্যমেই মুক্তি সাধন হয়'৷ চরম বিকৃত মনের এমন জঘন্য রসিকতার নজির আর কোথাও পাওয়া যায় না৷
শিবিরের কাঠামো
প্রায় জনমানবশূণ্য এক এলাকায় প্রায় ৪০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নাৎসিরা গড়ে তুলেছিল আউশভিৎস-বির্কেনাউ নিধন শিবির৷ ফলে হিংস্র অ্যালসেশিয়ান কুকুর সহ সশস্ত্র রক্ষীদের কড়া নজর পেরিয়ে সেখান থেকে পলায়নেরও তেমন উপায় ছিল না৷
বড় নির্মম ছিল সেই হত্যাযজ্ঞ৷ রেলপথে মালগাড়ি করে গবাদি পশুর মত যেসব মানুষকে শিবিরে নিয়ে আসা হত, তাদের ঠিক জানা ছিল না, কেন তাদের সেখানে আনা হয়েছে বা তাদের সঙ্গে কী করা হবে৷ প্রথমেই তাদের মধ্য থেকে কর্মক্ষম মানুষদের আলাদা করা হত৷ মা ও শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, অসুস্থ মানুষদের তাদের পরিবারের বাকিদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে বেশী সময় নষ্ট না করে পাঠিয়ে দেওয়া হত গ্যাস চেম্বারে৷ নারকীয় সেই নিধনযজ্ঞের পর আউশভিৎসের মধ্যে অবস্থিত ৪টি শ্মশানে তাদের লাশের গণদাহ করা হত৷ নাৎসিদেরই সূত্র অনুযায়ী দিনে প্রায় ৪,৭০০ দেহ এভাবে পোড়ানো হত৷ যারা আরও কিছুদিন জীবিত থাকার সুযোগ পেত, কঠিন পরিশ্রম করতে করতে তারা অর্ধ-মৃত হয়ে যেত৷ আউশভিৎস নিধন শিবিরের কাছাকাছি গড়ে উঠেছিল কিছু শিল্প কারখানা, যেখানে বন্দিদের দাস হিসেবে কাজ করতে হত৷ শিবিরের মধ্যে তাদের গবাদি পশুর মত বসবাস করতে হত৷ এমনকি তাদের ত্বকের উপর গরু-ভেড়ার মত সংখ্যা লেখা উল্কিও শোভা পেত৷
শেষের অবস্থা
১৯৪৩ সালে প্রায় ১ লক্ষ মানুষকে কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে কাঠের তৈরি প্রায় ২০০ গুদামঘরে রাখা হত৷ ১৯৪৪ ও ৪৫ সালে যখন রেড আর্মি এগিয়ে আসছে বলে খবর এল, তখন অসংখ্য বন্দিকে পায়ে হাঁটিয়ে অন্যান্য কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল নাৎসিরা৷ ‘ডেথ মার্চ' বা মৃত্যুর পাদচারণা – বলে পরিচিত সেই যাত্রা শেষ করতে পারেন নি অনেকেই৷ অবশেষে ১৯৪৫ সালের ২৭শে জানুয়ারি যখন সোভিয়েত সৈন্যরা আউশভিৎস মুক্ত করল, তখন সেখানে মুমূর্ষু ও মৃতপ্রায় প্রায় ৫,০০০ মানুষ মৃত্যুর দিন গুনছেন৷ নাৎসিরা তাদের ফেলেই চলে গিয়েছিল৷ ১৯৪৭ সালে পোল্যান্ডের সংসদ আউশভিৎস শিবিরকে জাতীয় জাদুঘরের মর্যাদা দেয়৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন, সম্পাদনা: আবদুল্লাহ আল ফারূক