1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই!

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া
৩০ মে ২০১৭

মাসদার হোসেন মামলার পূর্ব পর্যন্ত সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার জন্যে রাষ্ট্রের উপর দায়িত্ব অর্পণ করার কথা থাকলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি৷

https://p.dw.com/p/2dg9q
সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ন্যায়বিচারের ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে
ছবি: bdnews24.com

এটি মূলত সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগে বর্ণিত মূলনীতির অন্তর্গত বিধায় ৮ অনুচ্ছেদের মর্ম মতে, এটি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য ছিল না৷ কিন্তু তারপরও আমরা এই মূল নীতির আদালতের মাধ্যমে কার্যকর হতে দেখেছি মাসদার হোসেন মামলায়, যা একটি ব্যতিক্রম হিসেবে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে লেখা থাকবে৷

এখানে বিশেষভাবে খেয়াল করা দরকার মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরেও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পদ চিরতরে বিলুপ্ত হয়নি, বরং বিচার বিভাগের উপর শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে নতুন নতুন অনেক আইন এসেছে, যেখানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে৷ ‘ভ্রাম্যমান আদালত আইন' তেমনই একটি আইন, যেখানে দ্রুত সমাধান দেয়ার কথা বলে বিচার বিভাগের উপর শাসন বিভাগের হস্তক্ষেপ জারি রাখা হয়েছে৷

এই আইনের পক্ষে দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল থেকে শুরু করে অনেক বিজ্ঞ আইনজীবীকেই পক্ষ নিতে দেখা যায়৷ বিষয়টি এমন নয় যে, তারা এই সহজ ব্যাপারটি বোঝেন না৷ কিন্তু সর্বগ্রাসী দলীয়করণের ফলে ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম' চলে বিধায় অনেক নতুন নতুন ব্যাখ্যারও আমদানি হয়েছে৷ একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা খর্ব করে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে বিচারপ্রক্রিয়া চালু করার আদেশ দিলে, দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়৷

এরই মধ্যে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ৷ এই ‘রাষ্ট্রপক্ষ' ধারণাটিও বেশ কৌতূহল উদ্দীপক বটে৷ ‘সরকারপক্ষ' আর ‘রাষ্ট্রপক্ষ' যে একই বিষয় নয়, সেটি আমাদের মনে থাকে না৷ রাষ্ট্র ধারণার মধ্যে তিনটি বিভাগের কথা বলা হলেও কার্যত সাধারণের ধারণায় রাষ্ট্রপক্ষ মানে ‘সরকারপক্ষ' এ রকম একটি ধারণা প্রতিষ্ঠা করে দেয়ার চেষ্টা চালু আছে৷

মাননীয় প্রধান বিচারপতি অনেক দিন থেকেই বলে আসছেন সরকার নিম্ন আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করছে, এখন তারা উচ্চ আদালতকেও কব্জায় নিতে চায়৷ একই রকম বক্তব্য এসেছে গত ২৩শে মে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানির সময়৷ সংবিধান সংশোধনী ঠিক কিনা তা বিচার বিভাগের বিবেচনা করার সুযোগ নেই মর্মেও যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে অ্যাটর্নি জেনারেলের পক্ষ থেকে৷ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে হবে, সেটি নিয়ে জন লকি থেকে শুরু করে পরবর্তী দার্শনিক ও আইনবেত্তাগণ অনেক তত্ত্ব বা ধারণা দিয়েছেন৷

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টছবি: privat

সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের তিন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকার কথা এবং একে অপরের সম্পূরক হিসেবে কাজ করার কথা বলেছেন৷ এটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক৷ রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে সমন্বয়, নাকি একে অপরের ক্ষমতার অপব্যবহারের উপর নজরদারি করবে, সেটিও আলোচনায় এসেছে৷

বিচার বিভাগের উপর শাসন বিভাগের হস্তক্ষেপ বিষয়ে আলোচনা চলমান আছে সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে ভাস্কর্য স্থাপনাকে কেন্দ্র করে৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন সাংবাদিকদের বলেন, তিনি প্রধান বিচারপতিকে বলবেন ‘মূর্তি' সরানোর জন্যে৷ তখন এই বিতর্ক নানান ডালপালা ছড়াতে থাকে৷ ২৫শে মে দিবাগত রাতে এই ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে জনসাধারণের কাছে ভুল ইঙ্গিত গিয়ে থাকতে পারে৷

মাননীয় প্রধান বিচারপতি গত ২৩শে মে যে মন্তব্য করেছেন তার দুটো স্পষ্ট দিক আছে৷ এক– নিম্ন আদালত সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন, দুই– উচ্চ আদালতকে সরকার কব্জায় নিতে চাইছে৷ মাসদার হোসেন মামলার পরে নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ আইন মন্ত্রণালয়ের উপর থাকার কোনো সঙ্গত কারণ নেই৷ বাংলাদেশ আইন কমিশনের প্রস্তাবনার সূত্র ধরে বিচার বিভাগের নিজস্ব সচিবালয় স্থাপনার যে দাবি, তাতেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি৷ উচ্চ আদালতকে কব্জায় নেয়ার বিষয়ে যে বক্তব্য এসেছে, তা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ রয়েছে৷ প্রত্যক্ষ কব্জায় নেয়া ছাড়াও যে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব তা বাংলাদেশের যে কোনো বিভাগের দিকে তাকালেই বোঝা যায়৷ দেশে এমন একটি প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে দলীয়করণ হয়নি৷

বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট নির্বাচনে কে প্রার্থী হবেন আর কে হবেন না, সেটিও সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয় বলে জানা যায়৷ একইভাবে বিচারবিভাগে নিয়োগে প্রক্রিয়া দলীয়করণ হওয়ার কারণে প্রচ্ছন্ন নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে অনেক আগে থেকেই৷ বিচারক নিয়োগের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন না করা হলে এই নিয়ন্ত্রণ থামানোর কোনো উপায় নেই৷ দলীয় আনুগত্য যেখানে নিয়োগের মূল যোগ্যতা, সেখানে অপরাপর যোগ্যতা বরাবরই অকার্যকর৷

সংবিধানে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা মাননীয় রাষ্ট্রপতির হাতে দেয়া থাকলেও আসলে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া যথেষ্ট জটিল এবং এককেন্দ্রিক৷ এখানেও নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান৷

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করার যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতেও শাসন বিভাগ কর্তৃক বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে বলে দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন৷ যেহেতু এই সংশোধনী বাতিল চেয়ে করা আপিলের শুনানি চলছে, তাই আপিলের রায় না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে৷ এই রায়ের মাধ্যমে হয়ত অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নের সমাধান পাওয়া যাবে৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য