জার্মানিতে লঙ্গরখানা
২৫ আগস্ট ২০১৩জার্মানি সমৃদ্ধ দেশ৷ কিন্তু এখানে প্রত্যেক পাঁচজন শিশুর মধ্যে একটি শিশুর ভালোমন্দ সরকারের বদান্যতার উপর নির্ভর করে৷ দেশে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ নিম্ন বেতন কিংবা পারিশ্রমিকে কাজ করে৷ জার্মানিতে দারিদ্র্যসীমা যতই উঁচু হোক না কেন, এক কোটি বারো লাখ মানুষ জীবনধারণ করেন সেই দারিদ্র্যসীমার প্রান্তে কিংবা তার নীচে৷ জার্মান সরকারের সর্বাধুনিক ‘‘দারিদ্র্য রিপোর্ট''-এ এসব পরিসংখ্যান দেওয়া আছে৷
দারিদ্র্যের নানা রূপ৷ জার্মানিতেও কাঙালিভোজন করানো হয়, ভাবতে পারেন? এখানে সেগুলোকে বলে ‘টাফেল' বা টেবিল, অর্থাৎ খাবারের টেবিল৷ এই সব ‘টাফেল' আসলে এক ধরনের লঙ্গরখানা৷ গরীব মানুষজন সেখানে গেলে হয় বাড়ি নিয়ে যাওয়ার খাদ্যসামগ্রী পায়, কিংবা হয়ত সেখানে বসেই এক প্লেট স্যুপ, কিংবা একবেলার খাবার খেতে পারে৷ জার্মানির বড় বড় শহরগুলোতে ইতিমধ্যে ১৫ লাখ মানুষ এই সব ‘টাফেল'-এর উপর নির্ভর৷ এই লঙ্গরখানাগুলি চলে দাতাদের বদান্যতায় এবং স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্যোগ ও পরিশ্রমে৷
নিখর্চার সমাজসেবা
স্বেচ্ছাসেবীদের এদেশে নাম আছে, সম্মান আছে৷ সরকারও সেই সুনামের ভাগ পেতে আগ্রহী৷ কাজেই ফেডারাল পরিবার মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, সরকার স্বেচ্ছাসেবীদের ভূমিকা আরো জোরদার করতে চান৷ রাজনীতির মঞ্চে এ নিয়ে ঢাক পেটানো চলে, আবার সরকারের খরচও বাঁচে৷ কেননা জার্মানিতে শুধুমাত্র ১৬টি প্রদেশের সরকারি ঋণই হলো ৬০ হাজার কোটি ইউরো৷ ওদিকে সামাজিক ভাতা, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি দেওয়ার দায়িত্ব প্রদেশগুলোর, ফেডারাল সরকারের নয়৷ কাজাই সব সরকারের নজরই ভলান্টিয়ার, মানে স্বেচ্ছাসেবীদের দিকে৷ তাদের দিয়েই সরকারের নিখর্চার সমাজসেবা – অন্তত তার একাংশ৷
‘খাবারের টেবিল'
এক হিসেবে ‘টাফেল' বা লঙ্গরখানাগুলো হলো সরকারের নিখর্চার সমাজসেবার সেরা উদাহরণ৷ বছর বিশেক আগে বার্লিনের কিছু মহিলা মিলে বিভিন্ন রেস্তরাঁ, হোটেল, সুপারমার্কেট থেকে ফেলে দেওয়া, কিংবা বিক্রির তারিখ পেরিয়ে যাওয়া খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করতে শুরু করেন৷ এভাবে তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিলেন: প্রথমত, খাদ্যদ্রব্যের অপচয় সম্পর্কে সমাজকে সচেতন করা; দ্বিতীয়ত, যাঁদের ঘরবাড়ি নেই, যাঁরা রাস্তায় থাকেন, তাঁদের একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা৷
আজ বার্লিনের সেই উদ্যোগ একটি জার্মানি ব্যাপী সংগঠনে পরিণত হয়েছে৷ পঞ্চাশ হাজার স্বেচ্ছাসেবী এই সংগঠনের হয়ে কাজ করেন৷ সারা দেশে ৯০০টির বেশি ‘টাফেল' বা লঙ্গরখানা আছে, খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয় তিন হাজারের বেশি ভাণ্ডার থেকে৷ এছাড়া এই লঙ্গর ও বিতরণকেন্দ্রের সংখ্যা বেড়েই চলেছে৷ শুধু যে নিরাশ্রয়, নিঃসম্বলরাই এখানে ভিড় করে, এমন নয়৷ সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেকার, পেনশনভোগী ও কম রোজগারের মানুষজন৷ কাজেই ফেডারাল জার্মান ‘টাফেল' সমিতি খানিকটা গর্বের সাথে ঘোষণা করেছে যে, তারা ‘‘এ যুগের বৃহত্তম সামাজিক আন্দোলনগুলির মধ্যে একটি'' হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
‘মধ্যযুগীয় পদ্ধতি'
রাজনীতি সেই ‘‘আন্দোলনের'' প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷ কিন্তু সমালোচকরা রাজনীতির এই মাখামাখি বিশেষ পছন্দ করেন না৷ তাদের বক্তব্য হলো, জার্মানির মতো ধনি দেশে এই মধ্যযুগীয় কাঙালিভোজনের পদ্ধতি যে আজও চলেছে, সেটাই একটা লজ্জার কথা৷ এমনকি সরকারি বেকারভাতা অফিস থেকেই নাকি লোকজনকে বলে দেওয়া হয়, বেকার ভাতায় না কুলোলে, ‘টাফেল' তো রইলই৷ কাজেই নাগরিকদের যেটা অধিকার হওয়া উচিত ছিল, সেটা এখন দয়ার দানে পরিণত হয়েছে৷
এভাবেই সরকারের দায়দায়িত্ব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীবর্গের বিবেক ও দায়িত্ববোধের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে৷ স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকরা স্কুলের উন্নতির জন্য সমিতি গঠন করে অর্থ সংগ্রহ করছেন৷ কিন্তু তারাও স্কুলবাড়ির মেরামত, কিংবা অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের জন্য চাঁদা তুলতে রাজি নন: কোনো একটা পর্যায়ে গিয়ে সরকারের দায়িত্ব সরকারেরই পালন করা উচিত, বলে মনে করেন তারা৷
তবে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির সবচেয়ে বড় উপযোগিতা বোধহয় এই যে, তারা সরকার ও আমলারা উপলব্ধি করার অনেক আগেই সমাজের প্রয়োজন-অপ্রয়োজন, অভাব-অনটনগুলির আভাস পায় এবং সে সম্পর্কে কিছু করার চেষ্টা করে৷ জার্মানির মতো স্বঘোষিত ‘‘সামাজিক রাষ্ট্রে'' ‘টাফেল'-গুলি সরকারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে৷ মানুষজনের শুধু চাকরিই নয়, তারা যা-তে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে, তেমন বেতন কি মজুরি পাওয়া প্রয়োজন৷