1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

লাস ফালাস, ভ্যালেন্সিয়ার অগ্নি যজ্ঞ!

১৮ মার্চ ২০১০

স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া নগরী শীতের শেষে, বসন্তের আগমনীতে মেতে ওঠে অগ্নি যজ্ঞে! ভারতের লোককথায় ‘সাড়ে তিন মণ ঘি পুড়িয়ে রাধার নৃত্যের’ যে অসম্ভব চিত্রকল্প আছে ভ্যালেন্সিয়াবাসী যেন এই আগুন উৎসবে সেই যজ্ঞকেই সম্ভব করে তোলে৷

https://p.dw.com/p/MVkE
ছবি: picture-alliance /dpa

শুরুর কথা

উৎসবের শুরু সেই মধ্যযুগ থেকে৷ কাঠমিস্ত্রীদের ‘দেবতা পিতা' হিসেবে পূজিত সেন্ট জোসেফ এই অগ্নি যজ্ঞের মূল চরিত্র৷ মধ্যযুগে কাঠমিস্ত্রীরা বসন্তের শুরুতে শীতের জমিয়ে রাখা অপ্রয়োজনীয় কাঠ, সরঞ্জামাদি একত্রে জড়ো করে পুড়িয়ে ফেলতো৷ সেই ঐতিহ্য থেকে শুরু হয়ে এখন তা রূপ নিয়েছে মহোৎসবে৷ যুক্ত হয়েছে আরও নানা আচার৷ নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা আর নানা সংস্থা আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে বানায় কাঠ, প্যাপিয়ারম্যাশে'র তৈরি বিশাল সব ভাস্কর্য, স্থাপনা কিংবা কাল্পনিক চরিত্র৷ তবে, বলাই বাহুল্য ক্ষণস্থায়ী এসব শিল্পকর্ম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে ব্যাঙ্গাত্মক৷ বানানো হয় দেশি-বিদেশী রাজনীতিবিদ, তারকা, এবং সিনেমা, কার্টুন কিংবা গল্প-উপন্যাস বা রূপকথার চরিত্রও৷ কয়েকদিন ধরে সারা নগরে তা প্রদর্শন শেষে উৎসবের শেষদিনে এসব পুড়িয়ে ফেলা হয়৷ আর এ রীতি থেকেই উৎসবের নাম ‘লাস ফালাস' বা ‘আগুন উৎসব'৷

কি হয় আগুন উৎসবে

মার্চ মাসের এক তারিখ থেকেই অনুষ্ঠান শুরু হলেও মূল উৎসব ১৫ থেকে ১৯ মার্চ৷ উৎসবের শেষ দিনটি সারা স্পেনে সেন্ট জোসেফ এর সম্মানে ‘পিতার দিবস' হিসেবে উদযাপিত হয়৷ এই দিনেই মানুষ একের পর এক মিছিল করে নিয়ে আসতে থাকে তাদের প্রতিমাসম এইসব শিল্পকর্ম৷ আর তা আগুনে পুড়িয়ে বিসর্জন দেওয়া হয় পিতার নামে৷ যাতে সব অশুভ দূর হয়ে নতুন শুভ দিনের দিকে যাত্রা করতে পারে মানুষ৷ মার্চের ১৯ তারিখে ভ্যালেন্সিয়া যেন আগুনে জ্বলতে থাকা এক আদিভৌতিক নগরীতে পরিণত হয়৷ চারদিকে আগুন আর আগুন, বাজি আর পটকা ফোটার শব্দ, ফড় ফড় করে আগুনে পুড়ছে সব, বাতাসে পোড়াগন্ধ, আর এর মধ্যেই অগুণতি মানুষের উল্লাস, সঙ্গীত-নৃত্যের আনন্দধ্বনিতে অগ্নিযজ্ঞে মত্ত ভ্যালেন্সিয়া৷ এ যেন সম্রাট নিরো'র আগুনে পুড়তে থাকা রোম৷

Valencia Fallas-Fest
ছবি: AP

উৎসবের প্রস্তুতি

আজকাল ভ্যালেন্সিয়ার সব এলাকারই নিজস্ব উৎসব আয়োজক পরিষদ আছে৷ এরাই ‘নিনো' বা এসব পাপেট বানানোর প্রয়োজনীয় অর্থ যোগাড় এবং উৎসবের অন্যান্য কাজকর্মের তদারকি করে থাকে৷ এমনকি ‘সিউতাত ফালেরা' নামে নগরের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় এজন্য স্থাপন করা হয় একটি বিশেষ শিবিরের৷ যেখানে প্রায় মাসখানেক ধরে শিল্পী কলাকুশলীরা বিশালাকৃতির সব নিনো, ট্যাব্লো বানিয়ে থাকে৷ এসব ব্যাঙ্গাত্মক চরিত্রের পাপেটের আকার এমনকি ২০ ফিট উঁচুও হয়৷ তবে অবশ্যই সবগুলোই প্রমাণ আকৃতির চেয়ে বড়৷ ব্যাঙ্গের পাশাপাশি থাকে অনেক কাল্পনিক চরিত্রও৷ থাকে অনেক অদ্ভুতুড়ে প্রতিকৃতিও৷

মূল আয়োজন

নানা ছোটোখাটো আচারের মধ্য দিয়ে উৎসব শুরু হয় মার্চের ১ তারিখ থেকেই৷ তবে মূল উৎসবের উন্মাদনা শুরু ১৫ মার্চ থেকে৷ তখন নগরের প্রধান প্রধান অনেক সড়কই বন্ধ করে দেওয়া হয়, বাস-ট্রামের রুট পরিবর্তিত হয়ে যায়৷ চারদিকে চলতে থাকে নববর্ষের মতো আতশবাজির খেলা৷ ব্যান্ডের উদ্দাম শব্দে ঝড় তুলে বাদকদল একের পর এক পাপেটের মিছিল নিয়ে প্রদক্ষিণ করতে থাকে সারা নগরী৷ বাছাই করা এলাকায় স্থাপন করা হয় নির্বাচিত সব নিনো, ট্যাব্লো৷ রাস্তাঘাট সাজানো হয় বিশেষ আলোকসজ্জায়৷ রাস্তার মোড়ে মোড়ে রকমারি মুখরোচক খাবারের দোকান৷ পানীয়ের সঙ্গে চলতে থাকে রাতদিনের আড্ডা, হৈ হুল্লোড় আর গান বাজনা৷ তবে মনে রাখতে হবে এই উৎসব কিন্তু শুরু হয় সাত-সকালে৷ একেবারে সকাল আটটায় উদ্দাম বাজনাতেই ভাঙবে আপনার ঘুম৷

Valencia Fallas-Fest
ছবি: AP

আছে প্রতিযোগিতাও

এই সব আয়োজনের নেপথ্যে কিন্তু চলতে থাকে বিভিন্ন এলাকা আর সংগঠনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা৷ লক্ষ্য একটাই সেরা আয়োজনের স্বীকৃতি ও বিজয়ীর সম্মান লাভ করা৷ প্রতিযোগিতা হয় মূলত দুইটি বিষয়ে৷ সেরা পাপেট এবং রাস্তা বা মহল্লার সেরা আলোকসজ্জা৷ তবে, এই প্রতিযোগিতা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও কেবলমাত্র সিটি হল-এর আয়োজন থাকে না প্রতিযোগিতায়৷ সেরা পাপেটকে বিশেষ সম্মান দিয়ে তা পোড়ানো হয় না৷ বরং তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় ‘ফালেরো জাদুঘর'-এ৷ প্রতিবছর একটি করে পাপেট জমা করার পাশাপাশি এই জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে আগুন উৎসবের ইতিহাসও৷

ভ্যালেন্সিয়ার কুমারী

কুমারী মাতা ‘মেরি'র সম্মানে নারীদের জন্য বিশেষ আয়োজন আছে লাস ফালাস উৎসবে৷ ১৭ এবং ১৮ তারিখে হয় কুমারীদের এই অনুষ্ঠান৷ ভ্যালেন্সিয়া রাজ্যের সব জায়গা থেকে হাজার হাজার তরুণী-যুবতী ঐতিহ্যবাহী বর্ণিল পোশাকে ফুল হাতে নিয়ে মিছিল করে আসে ‘প্লাসা দে লা ভিরখেন' বা মাতা মেরির চত্বরে৷ সেখানে সাজানো মেরির বিশালাকৃতির ভাস্কর্যের বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় তারা৷ আর এই মিছিলে সামিল নারীদের মধ্যে থেকে প্রতিবছর নির্বাচন করা হয় একজনকে৷ ভ্যালেন্সিয়ার কুমারী হিসেবে গৌরবের অধিকারী হন ওই নারী৷

বিসর্জনের যজ্ঞ

মার্চের ১৫ থেকে ‘প্লাসা দেল আয়ুন্তামিয়েন্তো'-তে ‘লা মাসক্লেতা' নামের প্রতিদিনের আতশবাজির খেলা শেষ৷ এবার বিসর্জনের যজ্ঞে একে একে সারা নগরের সব অপরূপ সুন্দর শিল্পকর্মগুলো পোড়ানো হবে৷ কদিন ধরেই সারা নগরে চলেছে আলোকসজ্জার উৎসব৷ তবে সে শুধু যুদ্ধের মহড়া মাত্র৷ ভ্যালেন্সিয়ার আসল লঙ্কাকাণ্ড উৎসবের শেষ দিন ১৯ মার্চ৷ এই রাতটি হল ‘লা নিত দে ফক' বা ‘আগুনের রাত'৷ সব পাড়া মহল্লার সবাই প্রস্তুত৷ মাসখানেকের বেশি সময় ধরে বহু পরিশ্রমে বানানো, সাজানো পনেরো বিশ ফিটের সব দৈত্যাকার পাপেটগুলোতে ঠাসা হবে বারুদ৷ মধ্যরাতে একত্রে জ্বলে উঠবে ভ্যালেন্সিয়া৷ বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা লেগে যাবে, আগুনের হলকায় চোখ ধাঁধিয়ে যাবে, পোড়া গন্ধে ভরে যাবে চারদিক৷ আগুনের প্রলয়যজ্ঞে জ্বলে পুড়ে শুদ্ধ হবে ভ্যালেন্সিয়া৷

প্রতিবেদক : মুনীর উদ্দিন আহমেদ

সম্পাদনা : দেবারতি গুহ