‘বিজেপিকে আমি দেখছি’
১১ জুন ২০১৪লোকসভা ভোটের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে যে লাগাতার রাজনৈতিক সন্ত্রাস শুরু হয়েছে, তা নিয়ে অভিযোগ জানাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গিয়েছিলেন রাজ্যের বামপন্থি নেতারা৷ বামফ্রন্ট সভাপতি বিমান বসুর সঙ্গে ছিলেন সিপিআইএম-এর রবীন দেব, আরএসপি-র ক্ষিতি গোস্বামী, ফরোয়ার্ড ব্লকের জয়ন্ত রায় এবং সিপিআই দলের মঞ্জুকুমার মজুমদার৷ ওঁরা দল বেঁধে গিয়েছিলেন, রাজনৈতিক সন্ত্রাস বন্ধ করা, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর থেকে মিথ্যে মামলা প্রত্যাহার এবং পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবিতে৷ অথচ রাজ্য সরকারের নয়া সদর দপ্তর ‘নবান্ন' থেকে ওঁরা বেরিয়ে এলেন মুখ্যমন্ত্রীর সব কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে৷
মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সহযোগী মন্ত্রী-আমলারা তার আগে কার্যত এত অমায়িক ব্যবহার করেন তাঁদের সঙ্গে যে বিরোধী বাম নেতারা দৃশ্যতই হকচকিয়ে যান৷ অথচ কিছুদিন আগেই এই রাজ্যে শাসকদল তৃণমূলের রাজনৈতিক সন্ত্রাসের অভিযোগ সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে বিজেপির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল যেদিন নবান্নে এসেছিল, সেদিন আদৌ দপ্তরেই আসেননি মুখ্যমন্ত্রী৷ বিজেপি প্রতিনিধিরা রাজ্যের মুখ্যসচিবের সঙ্গে দেখা করে ফিরে যান৷ সম্ভবত বাম নেতারাও এর থেকে বেশি গুরুত্ব আশা করেননি৷ মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের সঙ্গেও আদৌ দেখা করেন কিনা, সেই সন্দেহও সম্ভবত ছিল৷
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিমান বসু ও বাকি নেতাদের সসম্মানে নবান্নের ফটক থেকে ১৪ তলায় মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়৷ সেখানে লিফট থেকে বেরিয়েই বাম নেতারা দেখেন, খোদ মুখ্যমন্ত্রী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে তাঁদের জন্যে অপেক্ষা করছেন! এর পরে ফিশ ফ্রাই-দার্জিলিং চা সহযোগে আলোচনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই বেশিরভাগ কথা বলেছেন, বাম নেতারা শুধু শুনে গিয়েছেন এবং সায় দিয়েছেন৷ একটা পর্যায়ে বিমান বসু একটু তেড়ে ফুঁড়ে উঠে বলতে চেয়েছিলেন যে, তাঁদের দাবি না মানা হলে আন্দোলনের পথে হাঁটবে বামেরা৷ মুখ্যমন্ত্রীর নির্লিপ্ত জবাব, অবশ্যই৷ আন্দোলন করাই তো রাজনৈতিক দলের কাজ! ক্ষমতায় আসার পর যে বামপন্থিদের মুখে ‘প্লাস্টার' আটকে আগামী ২০ বছর চুপ করে বসে থাকার কথা বলতেন মুখ্যমন্ত্রী৷
প্রশাসক হিসেবে তো বটেই, রাজনৈতিক কৌশলের বিচারেও ধুরন্ধর বাম নেতাদের এদিন দশ গোল দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তার থেকেও বড় কথা, নিজের আচরণে এবং বক্তব্যে পরিষ্কার বার্তা দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রসার আটকাতে বামপন্থি দলগুলির উচিত তৃণমূলের পাশে দাঁড়ানো৷ যদিও মুখে বলেছেন, মোদী এবং বিজেপিকে তিনি দেখে নেবেন, বামপন্থিরা আগে নিজেদের ঘর গুছিয়ে নিক৷ মুখ্যমন্ত্রী প্রায় অভিভাবকের সুরে বাম নেতাদের বলেন, বিজেপি আপনাদের থেকে এত ভোট ভাঙিয়ে নিয়ে যায় কী করে! কংগ্রেসের অধীর চৌধুরিই বা কী করে এত ভোটে জেতেন! খোঁজ নিয়ে দেখুন, নির্ঘাত বামকর্মীরা তলে তলে কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন৷
এর পাশাপাশি প্রবীণ নেতাদের শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ ৭০ মিনিটের বৈঠকে বাম নেতারা রাজ্যে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের প্রসঙ্গ ফের তুলেছিলেন৷ মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়ে সেই আলোচনায় ইতি টেনে ফের চলে যেন নিজের কথায়৷ শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, সরকারের তরফে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও বামফ্রন্টের তরফে সিপিএম নেতা রবীন দেব নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে মত বিনিময় চালু রাখবেন৷
সাধারণ বাম-কর্মী সমর্থকদের মধ্যে এই বৈঠকের দু'রকমের প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে৷ একদল চূড়ান্ত হতাশ যে শেষে তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করে চলে এলেন বামফ্রন্টের নেতারা, যেখানে দলীয় কর্মীরা মার খাচ্ছেন, খুন হচ্ছেন৷ আর অন্য প্রতিক্রিয়া দারুণ ক্ষোভের যে বামপন্থি আন্দোলনের শেষ মর্যাদাটুকু নেতারা খুইয়ে এলেন নবান্নে৷ অন্যদিকে একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ এবং আমোদিত রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব যে তাদের আটকাতে শেষে চিরশত্রু বামেদের সঙ্গে আঁতাত করলেন তৃণমূলনেত্রী৷