‘ভাষাই হলো সেতু’
২ ডিসেম্বর ২০১৩ইভা আব্দুল্লা অনেকটা হালকা বোধ করছেন এখন৷ মনটাও প্রফুল্ল৷ অবশেষে ফ্রাইব্যার্গের টেকনিকাল ইউনিভার্সিটিতে তাঁর ডক্টরেটের থিসিস জমা দিতে পেরেছেন৷
কাজটি মোটেও সহজ ছিল না৷ সিরিয়া থেকে আসা ৩৮ বছর বয়সি এই গবেষক জার্মান ভাষায় তাঁর থিসিস লিখেছেন৷ ‘‘বেশ পরিশ্রমের কাজ'', বলেন ইভা৷ ভাষা সংশোধনের ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন এক ‘টিউটর'৷ অবসরপ্রাপ্ত হানেলরে উলিশ৷ ফ্রাইব্যার্গের কাছে ছোট্ট এক গ্রামে বাস করেন তিনি৷ ‘‘তাঁর সাহায্য ছাড়া লেখাটা এত তাড়াতাড়ি শেষ করা যেত না'', বলেন ইভা৷
সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন ‘টিউটররা'
‘‘দুই বছর আগে আমি থিসিসের প্রথম অংশটা মিসেস উলিশের কাছে সংশোধনের জন্য দিয়েছিলাম৷ সেই সময় আমি ছিলাম সন্তানসম্ভবা৷ মন মেজাজও ভালো থাকতো না৷ ডক্টরেটের থিসিসটা যে আদৌ শেষ হবে তা বিশ্বাসই হতো না৷ মিসেস উলিশ সাহস দিয়ে বলেছেন ‘ইভা তুমি পারবে এটা'৷ আর এজন্য আমি পেরেওছি৷''
টিউটর উলিখ বলেন, বিদেশি ছাত্রছাত্রীরা মাঝে মাঝে বেশ জটিল বাক্য লেখেন৷ বাক্য পড়ার পর শেষমেষ বোঝা যায় না বিষয়টি কী ছিল৷ তবে সংশোধন করার পর সহজবোধ্য হয়ে ওঠে এটি৷ ইভা এজন্য কৃতজ্ঞ৷
এর আগে রাশিয়া ও চীন থেকে আসা দুই ছাত্রীকেও সাহায্য করেছেন হানেলরে উলিশ৷ আরো ৩০ জন টিউটরও আছেন এই কর্মসূচিতে৷
২০১০ সালে যাত্রা শুরু
ফ্রাইব্যার্গের টেকনিকাল ইউনিভার্সিটি ‘আলোর বিন্দু' নামে একটি সমিতির সঙ্গে মিলে ২০১০ সালে বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়তা করার জন্য এই প্রকল্পটি চালু করেন৷ কেননা ব্যাচেলর ও মাস্টার্স কোর্সের অনেক ছাত্রছাত্রীই ভাষা সমস্যায় হিমশিম খান৷ দৈনন্দিন জীবনেও ভাষার বাধাটা কম নয় তাদের৷
সম্প্রতি অসাধারণ কাজের জন্য প্রকল্পটি জার্মানির বিদেশ দপ্তরের বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে৷ বন শহরে ডিএএডি আয়োজিত এক সম্মেলনে ২০, ০০০ ইউরো অর্থমূল্যের পুরস্কারটি উদ্যোক্তাদের হাত তুলে দেওয়া হয়৷
বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের জন্য এটি একটি বড় রকমের সাহায্য৷ এর ফলে তাদের লেখার গুণগত মান বৃদ্ধি পায়, বলেন টেকনিকাল ইউনিভার্সটির মানুয়েলা ইয়ুংহাউস৷ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০০ বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীর দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন তিনি৷ এর মধ্যে ২০০ জন এই ভাষা কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন৷
নানা ধরনের তৎপরতাও চলে
এই কর্মসূচিতে শুধু ভাষা-সাহায্যই নয় নানা ধরনের কর্মকাণ্ডও চালানো হয়৷ বিদেশি ছাত্রছাত্রীরা রূপকথার সন্ধ্যার আয়োজন করেন৷ পড়ে শোনান স্বদেশের গল্প কাহিনি৷ প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর তারা তাদের স্বদেশ ও সেখানকার শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে টিউটরদের কাছে তুলে ধরেন৷ জানান জার্মানিতে কত বাধা বিপত্তি তাদের অতিক্রম করতে হচ্ছে৷
গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব
এই ভাষা-সহায়তা কর্মসূচির মাধ্যমে বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী ও টিউটরদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বও গড়ে ওঠে৷ বলেন ‘আলোর বিন্দু' সমিতির কির্স্টিন হুটে৷ প্রকল্পের উদ্যোক্তাদের একজন তিনি৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘প্রথম দিকে আমরা বিশেষ করে পেনশন নেওয়ার বয়সি কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছি, তাঁরা অবৈতনিক এই কাজটি করতে ইচ্ছুক কিনা৷ খুব শিগগিরই ২০ জন যোগাযোগ করেন আমাদের সঙ্গে৷''
ইভা আব্দুল্লাহ হানেলরে উলিশকে খুব পছন্দ করেন৷ শুধু টিউটরই নয় একজন কথা বলার সঙ্গী ও তাঁর তিন সন্তানের ‘পালক-নানি' হিসাবেও৷ ইভা জানান, ‘‘সিরিয়ায় সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে আমার মা-বাবা পরিবার পরিজনের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয়নি৷ মিসেস উলিশ ও তাঁর স্বামী আমার মা-বাবার মতো৷ তাঁরা প্রয়োজন হলে আমার বাচ্চাদের দেখাশোনাও করেন, দাওয়াত দেন৷ এজন্য আমরা স্বদেশকে তেমন মিস করি না৷''
কথাগুলি হানেলরে উলিশকে আবেগাপ্লুত করে৷ একদিকে যেমন গর্ববোধ করেন, অন্যদিকে কিছুটা চিন্তামগ্নও হন তিনি৷ সিরিয়ার সমস্যাগুলি এখন আগের চেয়ে অনেক স্পষ্ট তাঁর কাছে৷ সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হতেন, যদি সেখানে শান্তি ফিরে আসতো আর আব্দুল্লাহ পরিবার স্বদেশে ফিরে যেতে পারতেন৷ ‘‘তাদের অভাব অনুভব করলেও যত শিগগির সম্ভব সিরিয়ায় তাদের দেখতে যেতাম'', বলেন হানেলরে উলিশ৷