ভারতের কিছু বিতর্কিত আইন
ভারতে এমন কিছু কিছু আইন আছে, যা খুবই স্পর্শকাতর৷ তাই এ সব আইন নিয়ে প্রশ্ন তুললেই শুরু হয়ে যায় তুমুল বিতর্ক৷ তখন শেষ পর্যন্ত আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়, দিতে হয় সমাধান৷ এই রকমই কয়েকটি আইন তুলে ধরা হলো ছবিঘরে৷
৩৭০ ধারা
ভারতীয় সংবিধানের এই ধারায় জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে অন্যান্য রাজ্যগুলির তুলনায় কতগুলি ক্ষেত্রে স্বশাসনের বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছে৷ রাজ্য গণপরিষদ এর সংশোধনের সুপারিশ না করায়, এটা এ মুহূর্তে স্থায়ী বিধান হয়ে আছে৷ তবে জাতীয় নিরাপত্তা, অত্যাবশ্যক পণ্য, সর্বভারতীয় নিয়োগ বিধি, কর ও শুল্ক, আদালত, মানবাধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে জম্মু-কাশ্মীর অন্যান্য রাজ্য থেকে অভিন্ন৷
সোচ্চার সংঘ পরিবার
৩৭০ নম্বর ধারা রদ করার জন্য ভারতে সংঘ পরিবারের মতো কট্টর হিন্দু সংগঠনগুলি জোর আন্দোলন শুরু করেছে৷ সরকারকে তারা ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে এ জন্য৷ তাদের মতে, এই ধারা ভারতের সংহতি ও অখণ্ডতার পরিপন্থি৷ শুধু তাই নয়, এই ধারা নাকি জম্মু-কাশ্মীরের অশান্ত পরিস্থিতির জন্য অনেকখানি দায়ী৷ সরকার অবশ্য এই বিতর্কে নিজেকে জড়াতে চাইছে না৷
এএফএসপিএ বা আফস্পা
সেনাবাহিনীর বিশেষ অধিকার আইন বা এএফএসপিএ কার্যকর হয় ১৯৫৮ সালে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য এবং জম্মু-কাশ্মীরে৷ জঙ্গি তৎপরতা রুখতে এই আইনে সেনাবাহিনীকে দেয়া হয়েছে অবাধ ক্ষমতা৷ এতে করে ইচ্ছামতো গ্রেপ্তার, যখন খুশি তল্লাসি, কোনো কারণ না দেখিয়ে আটক এবং নির্যাতন করতে পারে মিলিটারি৷ তবে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, এ আইন অনির্দিষ্টকালের জন্য বলবত থাকতে পারে না৷ বরং ক্ষেত্রবিশেষে তদন্ত করতে হবে৷
প্রতিবাদী নারী শর্মিলা চানু
মানবাধিকার সংগঠনগুলি আফস্পার বিরুদ্ধে সোচ্চার৷ অভিযোগ, গত দু’দশকে মনিপুরে এ আইনকে কাজে লাগিয়ে সাজানো সংঘর্ষে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করেছে সেনাবাহিনী৷ এ সব হত্যাকাণ্ডের বিচার ও মনিপুর থেকে আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে ১৬ বছর ধরে অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন লৌহমানবী ইরম শর্মিলা চানু৷ নাকে ১৬ ইঞ্চির টিউব লাগানো তাঁর এই প্রতিবাদী ছবি গোটা দুনিয়া চেনে৷ আত্মহত্যার মামলা দায়ের করেও তাঁকে থামানো যায়নি৷
৩৭৭ ধারা
ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় সমকামিতা এখনও অপরাধ৷ সমলিঙ্গের দুই প্রাপ্তবয়স্ক যদি পারস্পরিক সম্মতিতে যৌনকাজে লিপ্ত হয় এবং সেটা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলেও ৩৭৭ নং ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে ১০ বছরের জেল, এমনকি যাবজ্জীবন কারাবাসও হতে পারে৷ ভারতের সমকামী গোষ্ঠীগুলি ব্যক্তিস্বাধীনতার খেলাপ মনে করে এই আইন বাতিল করার দাবি জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিীন ধরে৷ তবে বিষয়টি নিয়ে ভারতের জনমত বিভাজিত৷
এলজিবিটি সম্প্রদায়ের নতুন পিটিশন
সম্প্রতি ভারতীয় দণ্ডবিধির এই ৩৭৭ নম্বর অনুচ্ছেদটির বিরুদ্ধে আবারো পিটিশন দায়ের করেন এলজিবিটি সম্প্রদায়ের কয়েকজন সেলিব্রেটি৷ বের হয় মিছিলও৷ হাতের প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুনে লেখা থাকে ছিল, ‘সমকামীদের ব্যক্তিগত জীবন বেছে নেবার অধিকার দিতে হবে৷’ ঋতু ডালমিয়া, আমন নাথ এবং নৃত্যশিল্পী এনএস জোহর-এর মতো তারকারা ছিলেন সেই মিছিলে৷
পণপ্রথা বিরোধী আইন
ভারতে আজও পণপ্রথা বিরোধী আইনের ৪৯৮-এ ধারাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কখনও কখনও ঘটে যায় বধু হত্যার মতো ঘটনা৷ এই ধারা অনুযায়ী, বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে স্ত্রী আত্মহত্যা করলে বা তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে, স্বামী বা অন্য সদস্যদের প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা নির্দোষ৷ তা নাহলে বধু নির্যাতনের অপরাধে তিন বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে৷ তবে স্ত্রী যাতে এই আইনের অপব্যহার না করেন, সেদিকটাও এবার খতিয়ে দেখতে চায় আদালত৷
আত্মহত্যা না খুন?
এ বছরের জানুয়ারি মাসে দিল্লির ফতেপুর বেরিতে ২২ বছরের নববিবাহিতা বধু ববিতাকে শ্বশুরবাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়৷ বৌটির বাপেরবাড়ির লোকেদের অভিযোগ, পণের জন্য ববিতার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতো তাঁর স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেরা৷ আর সে কারণেই ববিতা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় অথবা আত্মহত্যার মোড়কে তাঁকে খুন করে শ্বশুরবাড়ির লোকেরাই৷
জাতিভেদ প্রথা অপরাধযোগ্য
জাতিভেদ বা অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ আইনের ১৭নং ধারায় এই আইন লঙ্ঘনে ছ’মাসের জেল ও জরিমানার কথা বলা হয়েছে৷ কারণ মানুষের ব্যক্তি অধিকার মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে৷ সামাজিক মেলামেশা, খাওয়া-দাওয়া, ওঠা-বসা, ধর্মীয় স্থানে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে নীচু জাত আর উঁচু জাতের মধ্যে বিভেদ করা অবৈধ৷ ১৯৭১ সালে আইনটি সংশোধন করে তার নাম দেওয়া হয় নাগরিক অধিকার সুরক্ষা আইন৷
দলিতরা কি মানুষ নয়?
মন্দির তো দূরের কথা, সম্প্রতি গুজরাট, উত্তর প্রদেশ এবং দক্ষিণ ভারতের কিছু গ্রামে দলিত ও হরিজনদের কুঁয়ো থেকে জল নিতে বাধা দেওয়া হয় গ্রামের মোড়লদের নির্দেশে৷ এ নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা দেখা দিলে, পুলিশ পাহারা বসাতে হয়৷ শেষে দলিতরা নিজেদের জন্য আলাদা কুঁয়ো খুঁড়ে নেন৷ প্রচণ্ড খরা সত্ত্বেও গুজরাটের মেহসানা জেলার ডজন খানেক মহিলা কাকুতি-মিনতি করলেও তঁদের কুঁয়ো থেকে জল নিতে দেওয়া হয়নি৷
লিঙ্গ বৈষম্য নিরোধক আইন
দেব-দেবীর মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকার না থাকায়, তার বিরুদ্ধে নারীবাদী সংগঠনগুলি সোচ্চার সর্বদাই৷ কিন্তু মন্দির কর্তৃপক্ষের মন এতে টলেনি৷ ধর্মগুরুদের মতে, প্রাচীনকাল থেকেই মাসিকের সময় মেয়েদের ‘অশুচি’ বলে গণ্য করা হয়৷ তাই তাদের ঢুকতে দেওয়া হয় না৷ এ নিয়ে আন্দোলনকারীরা আদালতের দ্বারস্থ হলে মুম্বই হাইকোর্ট মন্দির প্রবেশাধিকার আইন ১৯৪৭ অনুসারে রায় দেয় যে, মন্দিরে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য করা যাবে না৷
মন্দিরে প্রবেশাধিকার নিয়ে আবারো আপিল
তৃপ্তি দেশাইয়ের নেতৃত্বেই একদল মহিলা মহারাষ্ট্রের আহমেদনগরে একটি শনি মন্দিরে ঢোকার চেষ্টা করেন৷ মন্দির কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ তাঁদের বাধা দিলে, তাঁরা সেখানেই ধর্ণা দেন৷ মুম্বইয়ের রাস্তায় মন্দিরে মেয়েদের অবাধ প্রবেশাধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল হয়৷ এরপর কিছু কিছু মন্দিরে নারীরা প্রবেশাধিকার পেলেও, কেরালার সবরিমালা এবং অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুপতি মন্দির কর্তৃপক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে৷
মুসলিম শরিয়ত বিধি ১৯৩৭
‘মুসলিম পার্সোনাল ল’ নিয়ে সরকার দোটানায়৷ সংবিধানে নারী-পুরুষকে সমানাধিকার দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু মুসলমানদের জন্য সামাজিক বা পারিবারিক বিবাদে কোরান-ভিত্তিক শরিয়ত আইনই শেষ কথা৷ তবে মুসলিম নারীরা বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পুরুষদের এক তরফা তিন তালাকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে৷ আওয়াজ তুলেছে বহুবিবাহ, তালাক ও খোরপোষের দাবিতে৷ একদিকে সংবিধান, অন্যদিকে মুসলিম পুরুষ সমাজ৷ বিযয়টি তাই আদালতের ওপর ছেড়ে দিয়েছে সরকার৷
শাহ বানুর পর সায়রা বানু
ভারতের দেরাদনের ৩৫ বছরের সায়রা বানু সম্ভবত প্রথম মুসলিম মহিলা, যিনি সুপ্রিম কোর্টে তিন তালাক প্রথা রদ করার আর্জি জানিয়েছেন৷ সায়রা বানু উত্তরাখণ্ডে বাপের বাড়িতে গেলে তাঁর স্বামী রিজওয়ান আহমেদ এলাহাবাদ থেকে তালাকনামা পাঠিয়ে ১৫ বছরের দাম্পত্যজীবনের ইতি টানতে চান৷ বিয়ের পরে বহবার গর্ভপাতে আজ অসুস্থ সায়রা৷ তারপরও এই অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে মরিয়া সায়রা বানু৷