বিশ্বে প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে বাধ্য করা হচ্ছে পতিতাবৃত্তি করতে
১৭ জুলাই ২০১০ইসোক আইকপিটানী শুধু একটু ভালো ভাবে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন৷ সুদূর নাইজিরিয়ার বেনিন শহরে পারিবারিক একটি দোকান চালাতে হতো ইসোক'কে৷ বাড়ি থেকে সেই দোকান ছিল অনেক দূরে৷ কাঁহাতক আর এই গরমে রোজ রোজ এতো দূরে গিয়ে দোকান খুলে বসতে ভালো লাগে ? তাই লাগস'এর এক আইনজীবী যখন ইসোক'কে লন্ডনে থাকা এবং চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন বলে কথা দিলেন, তখন সত্যি কথা বলতে কি ইসোক যেন আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন৷
ইংল্যান্ডে বাড়ি, চাকরি, নিজের মতো করে বেঁচে থাকার সম্ভাবনায় নেচে উঠেছিলেন ইসোক, নিজেরই অজান্তে : ‘‘লাগস'এর একটি কোম্পানি আমাকে ইউরোপে চাকরি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়৷ ভালোভাবে কাজ করলে, ইউরোপের একটি ‘সুপার মার্কেটে' আমার চাকরি ঠিক করা আছে - এরকম কথাই বলা হয়েছিল আমাকে৷''
ইসোক আইকপিটানী'র গন্তব্য ছিল লন্ডন৷ কিন্তু যুক্তরাজ্য নয়, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ইটালি'তে৷ সেখানে নিয়ে গিয়ে ইসোক'কে এক জোড়া অন্তর্বাস পরিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় টুরিন শহরের অদূরে৷ পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য করা হয় তাঁকে৷ ইসোক জানান : ‘‘দু'বছরেরও বেশি সময় ধরে ইটালির রাস্তায় রাস্তায় আমাকে এ কাজ করতে হয়৷ বলা হয়, ইউরোপে নিয়ে আসার জন্য আমাকে মোট ৩০ হাজার ইউরো দিতে হবে তাদের৷ প্রথমদিকে আমি রাস্তায় বের হতে অস্বীকার করি৷ পরে শুনলাম, টাকা দিতে না চাওয়ায় একটি মেয়েকে খুন করতেও পিছু পা হয় নি এরা৷ তাই শেষ পর্যন্ত আমাকেও রাস্তায় নামতে হয়েছিল৷''
কিন্তু, একটা সময় নিজের অনিচ্ছায় নিজ শরীর নিয়ে বেচা-কেনা করতে মন আর সায় দিলো না ইসোক'এর৷ প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন তিনি৷ অপহরণকারীরা দেখলো আর উপায় নেই৷ তাই পেটে ছুরি ঢুকিয়ে, ইসোক'কে অচেতন অবস্থায় ফেলে রেখে পালিয়ে গেলো তারা৷ এরপর ইসোক'এর আর কিছু মনে নেই৷ কয়েক মাস বাদে যখন তাঁর জ্ঞান ফেরে, তখন তিনি হাসপাতালে৷ ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন ইসোক৷ প্রতিজ্ঞা করেন, এরপর আর কোনো দিন কারো হাতে নিজেকে ছোট করবেন না৷
ঠিক সেই সময় ইটালির এক নারী সাংবাদিক লরা মারাগনানি'র সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর৷ মারাগনানি'র সাহায্যে নিজের জীবন নিয়ে একটি বই-ও লেখেন ইসোক আইকপিটানী৷ নাম দেন, ‘বেনিন শহরের মেয়েরা : কৃতদাসী হয়ে নাইজিরিয়া থেকে ইটালির রাস্তায়'৷ ইসোক'এর মতো একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়ে জীবনের একেবারে অন্য একটি দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে সাংবাদিক মারাগনানি'র কাছে৷
তিনি বলেন : ‘‘ইটালিতে এসব মেয়েদের কোন মর্যাদা নেই৷ দেশের সাধারণ মানুষ এদের সামাজিক কলঙ্ক হিসেবেই দেখে৷ তাই আমাদের উচিত এদের সাহায্য করা, তাদের থাকা, খাওয়া এবং চাকরির ব্যবস্থা করা৷ তারা যাতে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো জীবনধারণ করতে পারে - সেটা নিশ্চিত করা৷ কারণ, তা নাহলে এরা নিজেরাই আবার মেয়ে পাচারের কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে৷ আর তখনই মানুষ পাচার পরিণত হয় একটি দুষ্টচক্রে৷''
এই অপরাধচক্র এড়ানোর একমাত্র উপায় অপহৃত মেয়েদের পুনর্বাসন৷ জানালেন রোম শহরের এক মানবাধিকার কর্মী আইরা বোটিলিরো৷ তবে পুনর্বাসনের মাধ্যমে মেয়েদের শুধু দুষ্টচক্র থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলেই হবে না, দারিদ্র্য দূর করা না গেলে এবং সমাজে মেয়েদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করা সম্ভব না হলে এ চক্রব্যুহ থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়৷
বোটিলিরো'র কথায় : ‘‘শিক্ষার অভাব, স্কুলের অভাব, বিচারের অভাব, আর তার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়া, বহু-বিবাহ, সম্পত্তির মালিকানা থেকে বঞ্চিত হওয়া - ইত্যাদি আরো নানা কারণে পিছিয়ে আছে আফ্রিকার মেয়েরা৷''
অবশ্য অন্যান্য মেয়েরা পিছিয়ে থাকলেও, দাসত্বের সেই দৈন্যদশা থেকে নিজেকে তুলে আনতে পেরেছেন ইসোক আইকপিটানী৷ অপহরণের দশ বছর পর, বেনিন'এর সেই কিশোরী মেয়েটির বয়েস আজ ৩০ বছর৷ তাই আর নিজের জন্য নয়, তাঁর মতো অভাগা মেয়েদের জন্যই একটি পুনর্বাসন সংস্থা গড়ে তুলেছেন ইসোক৷ যারা কাজ করছে সেই সব মেয়েদের অধিকার রক্ষায়, তাদের জন্য এক সুন্দর জীবন নিশ্চিত করতে৷
প্রতিবেদন: দেবারতি গুহ
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক