1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিপিএল হলো ক্রিকেটপ্রেমের মাশুল!

৮ ডিসেম্বর ২০১৬

প্রথম বিপিএল-এর ঘটনা৷ রাতে অফিস থেকে গেছি এই জেনে যে চার সেমিফাইনালিস্টের একটি হচ্ছে চিটাগাং কিংস৷ পরদিন বিস্ফারিত চোখে দেখলাম, ওদের জায়গায় বরিশাল বার্নার্স! খোঁজ নিয়ে যা শুনলাম তাতে মফস্বলের টুর্নামেন্টের কথা মনে পড়ল৷

https://p.dw.com/p/2TwAG
Bangladesch Cricket Premier League
ছবি: Mir Farid

মফস্বলে যেসব ক্ষেত্রে একটা আয়োজক কমিটি থাকে, তারা নিজেদের ইচ্ছামতো আইন-টাইন বদলে পছন্দের দলকে সেমিফাইনাল-ফাইনাল খেলিয়ে দেয়৷ তাই বলে সেটা দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে! তা ও সব ক্ষেত্রে কমিটির লোকদের আত্মরক্ষার্থে মাঝে-মধ্যে দৌড়াতেও হয়৷ এখানেও বিষয়টা প্রায় সেরকমই হয়েছিল৷ একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ম্যাচ রেফারি, যার অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা ইংরেজি, তিনি ইংরেজির ভুল ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এমন হেনস্তা হয়েছেন যে প্রায় পালানোর অবস্থা৷ বিষয়টা চূড়ান্ত রকম হাস্যকর৷ কিন্তু ভেবে দেখলাম একেবারেই কি অপ্রত্যাশিত? অল্প ক্রিকেট-বেশি নাচ-গান, সামান্য খেলা বিপুল পরিমাণ ধূলা মিলিয়ে যে একটা মেঘাচ্ছন্ন আকাশ বিপিএলকে ঘিরে ছিল শুরু থেকেই, তাতে তো এমন কিছুই হওয়ার কথা৷

এই জাতীয় মতিগতি দেখে পত্রিকায় অনেক লেখা হয়েছে৷ আশঙ্কার সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী ছিল৷ কেউ শোনেনি৷ এবং আসলে আইপিএল-বিপিএল জাতীয় প্রতিযোগিতায় এগুলো কেউ শুনতে চায় না৷ ক্রিকেটের সঙ্গে মশলা মিশিয়ে এমন একটা উপাদান তৈরি হয় যাতে বাজার আর বাণিজ্যই এক এবং একমাত্র অঙ্ক৷ ক্রিকেটাররা এখানে যত না খেলোয়াড় তার চেয়ে বেশি বিনোদনকারী৷

মাশরাফি ও মুশফিক
মাশরাফি ও মুশফিকছবি: Mir Farid

দর্শকরা যত না ক্রিকেটপ্রেমী বলে বিবেচিত, তার চেয়ে বেশি ভোক্তা৷ মানুষ নাচাও, টাকা কামাও এবং ‘টুর্নামেন্ট দারুণ সফল হয়েছে' ঢোল বাজাও – এই মোটামুটি মূলমন্ত্র৷ সেখানে কর্মের চেয়ে অপকর্ম বেশি ঘটবে এই তো স্বাভাবিক৷ তা যেসব ক্ষেত্রে এরকম হয়, অর্থাত্‍ সুবিধার চেয়ে সমস্যা বেশি, সেগুলো বাদ দিয়ে দেয়াই তো উচিত৷

কিন্তু সমস্যা হলো, তারপরও বিপিএলকে আমরা বাদ দিতে পারব না৷ ক্রিকেট বাস্তবতা আমাদের এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে যেখানে বিপিএল হচ্ছে সেই ‘দুষ্ট গরু' যাকে গোয়াল থেকে বের করে দেয়ার উপায় নেই৷ সব দেখব, জানব, তবু এই ‘প্রয়োজনীয় ক্ষত'-টা নিয়েই চলতে হবে৷

বিপিএল প্রয়োজনীয় এজন্য যে এখন টি-টোয়েন্টি ম্যাচ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের একটা অনিবার্য অনুষঙ্গ৷ ধরনের কারণে জনপ্রিয়তা এমন বাড়ছে যে এটা একসময় ক্রিকেটের মূল ফরম্যাটও হয়ে যেতে পারে৷ তা হোক না হোক, যেহেতু একটা বিশ্বকাপ পর্যন্ত হচ্ছে কাজেই টি-টোয়েন্টির জন্য তৈরি হতে হবে৷ আর তৈরির জন্য বিপিএল হচ্ছে আদর্শ মঞ্চ৷ এখানে খেলার মাধ্যমেই সেই পর্যায়ের জন্য সঠিক প্রস্তুতিটা হয়৷ সম্ভাব্য আগামী দিনের খেলোয়াড়দেরও দেখা মেলে এখান থেকে৷ এর বাইরে আরেকটু বিস্তৃত করে চিন্তা করলে সামগ্রিক ক্রিকেটেও লাভ আছে কিছু৷ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের খেলোয়াড়দের সঙ্গে এক দলে খেলে তরুণদের মধ্যে বিশ্বাস বাড়ে৷

বিপিএল ২০১৬-তে  বরিশাল বুলস
বিপিএল ২০১৬-তে বরিশাল বুলসছবি: Mir Farid

গেইলকে যখন আমাদের একজন তরুণ বোলার আউট করে তখন এই বিশ্বাসটা তার মধ্যে চলে আসে যে ‘আমার পক্ষেও সম্ভব'৷ মাঠ এবং মাঠের বাইরে দীর্ঘ সময় একসঙ্গে থাকা হয় বলে ওদের প্রস্তুতি, নিজেকে বিন্যস্ত রাখা এসব শিক্ষাও হয় সমান্তরালে৷

সমস্যাদগ্ধ প্রথম বিপিএলের পরই ঢাকায় হয়েছিল এশিয়া কাপ৷ সেটা ওয়ানডে টুর্নামেন্ট হলেও বিপিএলজাত বিশ্বাস সেখানে বাংলাদেশের সাফল্যের একটা নিয়ামক হয়েছিল৷ এরপর থেকে যে ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ খুব ধারাবাহিক সেই কৃতিত্বটাও বিপিএলকে কিছুটা দিতে হবে৷ তবে চুপিচুপি সতর্কবাণীটা জানিয়ে রাখা যাক৷ যতটা ঢোল সবাই বাজায় অতটা কীর্তিময় বিপিএল কখনোই নয়৷ যুক্তি আছে, তবে এর মধ্যে ফাঁকও প্রচুর৷ আইপিএল বা বিপিএল জাতীয় টুর্নামেন্টের সার্থকতার নিদর্শন হিসাবে প্রধান যে যুক্তিটা দেখানো হয়, তরুণ খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক তারকাদের সান্নিধ্য পাওয়া৷ আইপিএল-এ তারকামেলা বসে, কিন্তু আমাদের বিপিএল-এর সময় আন্তর্জাতিক দলগুলো খেলার মধ্যে থাকে বলে সাবেক তারকা এবং অন্য দেশের উঠতিরাই ভরসা৷ সাবেক তারকাদের নাম অনেক ভারী শোনায়, কিন্তু সাঙ্গাকারা-মাহেলারা এখন পুরনো দিনের মানুষ৷ এই টুর্নামেন্টগুলো তাঁদের কাছে স্রেফ একটা টুর্নামেন্ট, হয়ত টাকা রোজগারের জায়গা৷ এমন কিছু অর্জনের নেই বলে হালকা চালে খেলাই স্বাভাবিক, সেটা দেখে তরুণদের মনে হওয়া স্বাভাবিক ক্রিকেটটা আসলে এভাবেই খেলা উচিত৷ হালকা চালে৷ আয়েশী ভঙ্গিতে৷ নিবেদন, নিষ্ঠা,এগুলোর খুব দরকার নেই৷ সেটা কিন্তু ওদের বিপথে যাওয়ার পথেই এগিয়ে দেয়৷

মোস্তফা মামুন, উপ-সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ
মোস্তফা মামুন, উপ-সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠছবি: MIRFARID

দ্বিতীয় বিষয় হলো পার্টি কালচার৷ ব্যবসায়ীরা থাকেন মালিকানায়, সিনে অঙ্গনের লোকজন থাকেন শোভা বাড়াতে, দু'টো মিলে পার্টি আর উদ্দাম উত্‍সব৷ অল্প বয়সের ক্রিকেটাররা মাঠের ক্রিকেটের আগে পার্টিটা শিখে ফেলা কি ভালো? আর খেয়াল করলে দেখবেন এই ধরনের ক্রিকেট দিয়ে যাদের আবির্ভাব, তারা সাধারণত খুব স্থায়ী হতে পারে না৷ কারণ ক্রিকেটটাই তারা শেখে অন্যভাবে৷ এটা বরং কাজের হয় তাঁদের জন্য, যাঁরা ইতিমধ্যে ক্রিকেটে এসে খেলাটার চরিত্রটা ধরে ফেলেছে৷ ফলে ভালোটা নিয়ে ভুলটা দূরে রাখার ব্যাপারটা তারা বুঝতে পারে৷ তরুণ খেলোয়াড়দেরই তাই বুঝতে হবে, বাজারে দুধও পাওয়া যায়, মদও পাওয়া যায়৷ তাদের দুধটাই নিতে হবে৷ নিলে টিকে থাকবে৷ না হয় হারিয়ে যাবে৷ নিজেদের উপরই দায়িত্ব৷ দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে বড় সমস্যা অবশ্যই পাতানো৷ শুধুমাত্র ম্যাচ পাতানোর ঘটনার কারণে কোনো একটা টুর্নামেন্ট এক বছর বন্ধ ছিল এরকম ঘটনাই পৃথিবীতে বিরল৷ এবং এবারও সেই ম্যাচ পাতানোর গন্ধ৷ অভিযোগ পর্যন্ত পৌঁছেছে ঘটনা৷

বিপিএল বা এই জাতীয় ক্রিকেটের চরিত্রের সঙ্গে ম্যাচ পাতানো ব্যাপারটা এমনভাবে মিশে আছে যে এ থেকে পুরো মুক্তির কোনো পথ নেই৷ এমনকি যেখানে আইসিসি প্রধান পর্যন্ত সন্দেহের আঙুল পৌঁছে যায়, সেখানে বিসিবি এই আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান করে ফেলবে এই আশাও বাড়াবাড়ি৷ কিন্তু এই ক্ষেত্রে তবু একটা পয়েন্ট পাবে বাংলাদেশ বোর্ড৷ বিশেষ করে এই বোর্ড দায়িত্ব নেয়ার পর দ্বিতীয় বিপিএল-এ ম্যাচ পাতানোতে দায়ীদের যেভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছে সেটা খুবই প্রশংসার৷ পরের বিপিএল-এ তাই রোগটা একটু দূরেই ছিল৷ এবার আবার তার দুষ্ট হাতের ছায়া৷ এই সত্যটা মেনে নেই যে, এই ধরণের ক্রিকেটে ম্যাচ পাতানো ব্যাপারটা এমন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছে যে এটা পুরো দূর করার একটাই উপায় আর তা হলো, বিপিএল বন্ধ করে দেয়া৷ সেটা যখন আর সম্ভব নয়, তাই ম্যাচ পাতানো হবে এটা মেনে নেয়াই শ্রেয়৷ কিন্তু ঐ যে সহনীয় সীমার মধ্যে রাখা৷ ক্রিকেট বোর্ডের তত্‍পর থাকা৷

অপরাধীকে শাস্তি দিলে অন্তত পরের আসরটা নিরাপদ রাখা যায়; এই শিক্ষা তো আমাদের আছেই৷ ক্যানসারকে যেমন কেমো দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়, তেমনি তদন্ত আর শাস্তি দিয়েই শুধু এটাকে সহ্য সীমায় রাখা সম্ভব৷ ম্যাচ পাতানো বিষয়টা মেনে নেয়ার সুযোগ নেই, কিন্তু বিপিএল-এ আরেকটা আপত্তিকর বিষয় যেন সবাই মেনে নিয়েছে৷ এখানে পার্টি, নাচ-গান ইত্যাদি থাকবে৷ ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের জায়গায় বিদেশি কিংবা দেশি গ্ল্যামার গার্লদের রাখা হবে বিনোদন বাড়াতে৷ এখানেই বড় আফসোসটা৷ ক্রিকেট বা খেলাধুলা নিজেই এত বড় একটা বিনোদন যে আকর্ষণের নামে তাতে বাড়তি কিছু যোগ করার চেষ্টা করার মানে আসলে খেলাটাকেই অপমান করা৷

কিন্তু দুঃখের কথা কাকে বলি, খেলার এই অমর্যাদায় যাদের সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদী হওয়ার কথা সেই ক্রিকেটাররাই এই দুষ্ট নাচের সঙ্গে পা মেলান৷ ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে নিজেরাও নেমে যান প্রায় ভাঁড়ের স্তরে৷ নিজেদের খেলার শক্তি আর মর্যাদাটাই ওরা বুঝলেন না! প্রশাসকরা ব্যবসা আর ব্র্যান্ডিংয়ের নামে খেলাটাকে করে ফেলেন৷ সাবেক ক্রিকেটাররা বিনোদনের নামে নিজেদের সস্তা বানান৷ ক্রিকেটাররাই পাতানো খেলা খেলেন৷ তাহলে আর অক্ষম আমরা কী করতে পারি? পারি শুধু দুধ আর মদের তফাত্‍ করে ঠিক জিনিসটা বেছে নিতে৷ কেউ পয়সা বানানোর ধান্দা করবে, কেউ কেউ নষ্টামি ঢোকাবে কিন্তু এর মধ্যেও আমরা ক্রিকেট আর খেলাটাকেই দেখার চেষ্টা করব৷ দর্শক হিসাবে বাড়তি এবং কঠিন দায়িত্ব৷ কিন্তু কী আর করা! খেলাটাকে ভালোবাসি যখন, তখন ভালোবাসার উপদ্রবটা তো মানতেই হবে৷ বিপিএল তাই আসলে আমাদের ক্রিকেটপ্রেমের মাশুল৷

মোস্তফা মামুন, উপ-সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ

বন্ধু, মোস্তফা মামুনের এই লেখাটা কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান