বিনিয়োগের পিঠটান, দায় কার?
২১ জুলাই ২০১৪বন্ধ হয়ে গেল শালিমার পেন্টস-এর হাওড়ার কারখানা৷ ১১৩ বছরের পুরনো শালিমার পেন্টস ভারতে তো বটেই, গোটা দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার প্রথম রং প্রস্তুতকারক সংস্থা৷ ১৯০২ সালে ব্রিটিশদের হাতে এই হাওড়ার কারখানা থেকেই যার শুরু৷ গত মার্চ মাসে শালিমারের এই কারখানায় আগুন লাগে, যার পর পুড়ে যাওয়া অংশটি নতুন করে তৈরি করার দরকার পড়ে৷ কিন্তু আধুনিক অগ্নি নির্বাপণ বিধি এবং শিল্প সুরক্ষা বিধি মেনে ওই পুনর্নির্মাণ করতে গেলে যে পরিমাণ খরচ এখন করতে হবে, সেই অর্থ লগ্নি করার মতো পরিস্থিতি নেই, জানিয়েছে শালিমার সংস্থা৷ তার পরই হাওড়ার কারখানায় ‘সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক' বা সাময়িক কর্মবিরতির নোটিস, এর আগে যে নোটিস ঝুলেছে হিন্দমোটর, ডানলপ বা জেসপ কারখানার ফটকে৷ নামে ‘সাময়িক' হলেও, আসলে অনির্দিষ্টকালের জন্য, হয়তো চিরকালের জন্যও৷
কারণ, বন্ধ কারখানার ভুক্তভোগী শ্রমিকমাত্রেই জানেন, সরাসরি লক আউট ঘোষণা না করে এই সাসপেনশন অফ ওয়ার্কের বিজ্ঞপ্তি আসলে নিজেদের পিঠ বাঁচানোর আইনি কৌশল৷ হাওড়ার শালিমার কারখানায় যদিও শ্রমিকের সংখ্যা কমতে কমতে ১৫৪ জনে এসে ঠেকেছিল শেষমেশ৷ যদিও তাঁদেরও ট্রেড ইউনিয়ন ছিল এবং তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সেই ইউনিয়ন অভিযোগ করেছে, পুড়ে যাওয়া অংশ বিধিবদ্ধভাবে পুনর্গঠিত হলে সরকারের তরফ থেকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট পেতে কোনও অসুবিধে হত না৷ সরকার সর্বতোভাবে সহযোগিতার জন্য তৈরি ছিল৷ তবু সাময়িক কর্মবিরতির এই বিজ্ঞপ্তি আসলে রাজ্য সরকারকে অপদস্থ করতে৷ শালিমার কর্তৃপক্ষ যদিও ইউনিয়নের এই অভিযোগের কোনও জবাব দিচ্ছে না৷ তারা কেবল লগ্নির আকাল এবং স্থানীয় বাজারে শালিমারের পণ্যের মন্দা বাজারের কারণ দেখিয়েছে৷
এদিকে চলতি প্রবণতা অনুযায়ী শালিমার রং কারখানা বন্ধ হওয়ার যাবতীয় দায় গিয়ে পড়েছে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের ঘাড়ে৷ বিশেষত সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে রীতিমত হইচই করেছেন অর্থনীতি ও বাজার বিশেষজ্ঞরা৷ মুখ টিপে হেসে এমন টিপ্পনিও তাঁরা করেছেন যে, রাজ্যজুড়ে তো এখন নীল-সাদা রঙ করার ধুম পড়েছে, তাও একটা রংয়ের কোম্পানি রাজ্য ছেড়ে চলে যায় কী করে! ঘোষিতভাবে অথবা গোপনে যারা বর্তমান রাজ্য সরকারের বিরোধী, তারা আপাতদৃষ্টিতে রীতিমত উৎফুল্ল যে পশ্চিমবঙ্গে নতুন লগ্নি টানার এত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে উলটে পুঁজি বিদায় নিচ্ছে রাজ্য থেকে৷ এমনকি এহেন কুযুক্তিও শোনা গেল যে, বর্তমান রাজ্য সরকার যেহেতু ভারী শিল্পের তুলনায় মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে, ফলে বৃহৎ শিল্পে ব্যবহৃত ইন্ডাস্ট্রিয়াল পেন্টের চাহিদা কমেছে রাজ্যে৷ সেই কারণেই নাকি ব্যবসায় টিকতে পারল না শালিমার, ইত্যাদি৷
অথচ পরিকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা ছাড়া রাজ্য সরকারের কি সত্যিই কিছু করার আছে বা ছিল? বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ইদানীং প্রায়ই নিজেদের ব্যর্থতা বা অক্ষমতা ঢাকতে ৩৪ বছরের বাম অপশাসনের অজুহাত দেয়, কিন্তু এই একটি ক্ষেত্রে, অর্থাৎ রাজ্যে শিল্প বিস্তারের সম্ভাবনাকে সমূলে বিনষ্ট করার ওটাই ছিল কারণ৷ একদিকে বামপন্থি ট্রেড ইউনিয়নের জঙ্গিপনা, অন্যদিকে বিদ্যুতের আকাল থেকে শুরু করে সমস্ত ধরনের পরিকাঠামো সঙ্কট পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাণিজ্য সংস্থাগুলোকে কার্যত খেদিয়ে দিয়েছে৷ শালিমার পেন্টস-ও তাদের কর্পোরেট অফিস সেই ২০০০ সালেই এই রাজ্য থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল৷ হাওড়ার কারখানা উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ছিল মাত্র৷
অবশ্যই সিঙ্গুরে টাটার গাড়ি কারখানা রোখার আন্দোলন শিল্প পরিস্থিতির সহায়ক হয়নি৷ এ রাজ্যে শাসকগোষ্ঠীর খামখেয়ালিপনা এবং তার পাশাপাশি এক ধরনের প্রশাসনিক-রাজনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা বিনিয়োগকারীদের অস্বস্তি আরও বাড়িয়েছে৷ কিন্তু আদ্যিকালের কারখানার আধুনিকীকরণ এবং তার সুরক্ষাব্যবস্থা বিধিসম্মত করার দায় সরকারের নয়৷ ঠিক যেমন চলতি সময়ের চাহিদা না মেটাতে পেরে একটি গাড়ি কারখানা বন্ধ হয়ে গেল, তার দায়ও কোনও সরকারের হতে পারে না৷ যে সংস্থা আদি-অনন্তকাল ধরে শুধু একটি মান্ধাতার আমলের গাড়ির মডেলকেই আঁকড়ে থাকল, বাজার হারানোর দায় স্রেফ তাদের নিজেদের, অন্য কারও নয়৷ বরং সন্দেহ করা যায়, এরা কারখানা বন্ধ করার জন্যে তৈরি ছিল আগে থেকেই৷ দিল্লিতে নতুন সরকারের শিল্প-বান্ধব ভাবমূর্তি তাদের ঠিকানা বদল করার সাহস জুগিয়েছে মাত্র৷
ফলে, রাজ্য সরকারকে অপদস্থ করার জন্যই শালিমার পেন্টস বন্ধ হল, এই অভিযোগটা সম্ভবত ঠিক না৷ তবে এটা নির্ভুল যে বন্ধ করে দেওয়া সংস্থাগুলো এই রাজ্যের কথা, রাজ্যের মানুষের কথা, নিজেদের শ্রমিক-কর্মীদের কথা ভাবা বন্ধ করে দিয়েছিল অনেক আগে থেকেই৷