বিজ্ঞানের অসহায়ত্ব ভোপাল দুর্ঘটনা
১৪ জুন ২০১০১৯৮৪ সালের দোসরা ডিসেম্বর মধ্যরাত৷ ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের রাজধানী ভোপালে গভীর ঘুমে মগ্ন প্রায় নয় লাখ বাসিন্দা৷ হঠাৎ ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানার ৬১০ নম্বর ট্যাংকে ছিদ্র হয়ে পানি ঢুকে যায়৷ মিথাইল আইসোসায়ানেট তথা এমআইসি পানির সাথে মিশে ঘটে মারাত্মক রাসায়নিক বিক্রিয়া৷ প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে ৪০ টনের মতো এমআইসি নামক এই বিষাক্ত পদার্থ উপচে পড়ে ট্যাংক থেকে৷ কারখানার আশপাশে প্রায় আট কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জলাধার এবং বাতাসের সাথে মিশে যায় এই গ্যাস৷
কমপক্ষে তিন থেকে চার হাজার মানুষের ঘুম ভাঙ্গেনি সেই রাতে৷ এমনকি এই নিরীহ মানুষগুলো টেরও পায়নি, কী কারণে তাদের দুনিয়া ছাড়তে হলো আকস্মিকভাবে৷ তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়৷ এই বিষাক্ত গ্যাসের ছোবলে গত ২৫ বছরে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ৷ তাদের কেউ প্রাণ হারিয়েছে, কেউবা আহত কিংবা পঙ্গু৷ ক্যান্সার, যক্ষ্মাসহ নানা মরণব্যাধিতে ভুগছে ভোপালের অসংখ্য মানুষ৷ বিজ্ঞান এখনও জানে না, আর কয় প্রজন্মকে ভোগ করতে হবে এই দুর্ঘটনার প্রতিফল৷
বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির এই অসহায়ত্বের ফলে শুধু মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি৷ এর প্রভাব পড়েছে প্রাণিকুল এবং উদ্ভিদ জগতের উপরও৷ একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিষাক্ত এই গ্যাসের ছোবলে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় চার হাজার গরু-ছাগল, কুকুর, ইঁদুর এবং পাখিসহ অন্যান্য প্রাণী৷ ধ্বংস হয়ে গেছে নিম্নাঞ্চলের গাছপালা৷ নষ্ট হয়েছে এই অঞ্চলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য৷ ভারতের বিজ্ঞান ও পরিবেশ কেন্দ্রের সাম্প্রতিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই কারখানা থেকে তিন কিলোমিটার দূরের মাটিতে এখনও প্রায় ১১০ গুণ বেশি বিষক্রিয়া বিদ্যমান৷
ভোপালের মর্মান্তিক ঘটনার পেছনে দায়ী করা হচ্ছে রাসায়নিক কারখানার মালিক – মার্কিন প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন কার্বাইড এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডের গাফিলতিকে৷ কারখানাটির কর্তৃপক্ষের অসতর্কতা এবং অবহেলার কারণে এই দুর্ঘটনার পরিণাম গড়িয়েছে অনেক দূর, এমনটিও মন্তব্য অনেকের৷ এছাড়া এই অঞ্চলের মানুষের এতো ভোগান্তির পেছনে দায়ী করা হচ্ছে জনগণের সচেতনতার অভাব এবং স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতাকেও৷ ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সঠিক চিকিৎসা এবং তাদের পুনর্বাসনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি দীর্ঘ সময়েও৷
ভোপালের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের চিকিৎসার জন্য কাজ করছে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন৷ এগুলোর মধ্যে ‘সম্ভাবনা' একটি৷ সংস্থাটির মুখপাত্র সতিনাথ সারাঙ্গি বলেন, ‘‘এই অঞ্চলে বিদ্যমান বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের স্তূপ সম্পূর্ণ সরিয়ে ফেলার কাজটি এখনও কেউ করছে না৷'' জানা গেছে, দুর্ঘটনার এক বছর পর কারখানার পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে প্রায় ৩৫০ টন বর্জ্য তুলে তা কারখানার আঙিনায় জমা করা হয়৷ কিন্তু এক্ষেত্রে নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি৷ অবশ্য, মধ্যপ্রদেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পরিষদের ঊর্ধ্বতন সদস্য আর কে জৈন জানান যে, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই এই ৩৫০ টন বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা হবে৷
গত সপ্তাহে ভোপালের একটি আদালত এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য ইউনিয়ন কার্বাইডসহ এর সাবেক সাত কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিলেন৷ তবে এই রায়ে সন্তুষ্ট নন ঘটনার শিকার স্থানীয় বাসিন্দা এবং মানবাধিকার সংস্থাসমূহ৷ এই রায়ের দিকে ইঙ্গিত করে জৈন বলেন, আদালতে মামলাটি ঝুলে থাকায় এতোদিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্ভব হয়নি, তবে এখন তা করা হবে৷ এছাড়া ভারতের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিষদের সদস্য ড. চঞ্চল ঘোষ বললেন, ভোপাল দুর্ঘটনার পর থেকে শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং জনগণকে এ ব্যাপারে আরো সচেতন এবং সতর্ক করে তোলার জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷ এমন ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য শিল্প-কারখানাগুলোর উপর আরো কড়াকড়ি করা হচ্ছে৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন