বাজেট সামলাতে গিয়ে জার্মান সরকার উভয় সঙ্কটে
১০ জুন ২০১০ঋণের বোঝা
একটা ডিজিটাল ঘড়ি – তবে সময় দেখায় না৷ দেশে ঋণের বোঝা কীভাবে বেড়ে চলেছে, তার ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তুলছে এই ঘড়ি৷ সোমবার জার্মান সরকার যখন জনসমক্ষে ব্যয় সঙ্কোচনের নীতি তুলে ধরলো, তখন ঘড়ির পর্দায় রাষ্ট্রীয় ঋণের অঙ্ক ছিল ১৭১,৫৮৮ কোটি ইউরো'র থেকেও বেশি৷ গ্রিস, স্পেন ও পর্তুগালের বিশাল বাজেট ঘাটতির ফলে অভিন্ন মুদ্রা ইউরো'র অস্তিত্ব যে সঙ্কটের মুখে পড়েছে, সেখানে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে জার্মানিকে নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকার কথা নয় – এমনটা মনে করাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু বাস্তবে জার্মানির ঋণের বোঝাও অদূর ভবিষ্যতে বিশাল সঙ্কটের সৃষ্টি করতে পারে৷ তাই এখনই রাশ টেনে না ধরলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না৷
সরকারের সামনে বিকল্প
যে কোনো দেশেরই সরকারি কোষাগারের অবস্থা সামাল দিতে দু'রকম ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে৷ প্রথম পথ হলো আয় বাড়ানো – যার অর্থ আয়কর বা বিক্রির উপর করের হার সামান্য হলেও বাড়িয়ে দেওয়া৷ বলাই বাহুল্য, এমন সিদ্ধান্ত নিলে জনরোষের আশঙ্কা রয়েছে৷ অনেক সময় সরকারি মালিকানায় থাকা সম্পত্তি বিক্রি করলেও কিছু বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করা যায়৷ দ্বিতীয় পথ – সরকারি ব্যয় কমানো৷ জার্মান সরকার মূলত এই দ্বিতীয় পথই বেছে নিয়েছে – যার আওতায় সরকার আগামী ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর প্রায় ৮,১৬০ কোটি ইউরো কম ব্যয় করবে৷ প্রায় ১৬ ঘণ্টা ধরে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের পর আঙ্গেলা ম্যার্কেল'এর মন্ত্রিসভার সদস্যরা এবিষয়ে একটা ঐক্যমতে পৌঁছতে পেরেছেন৷ ম্যার্কেল বলেন, ‘‘গত কয়েক মাস ধরে গ্রিস ও ইউরো এলাকার পরিস্থিতির আলোকে আমাদের বুঝতে হবে, আর্থিক কাঠামোর ভিত্তি মজবুত রাখা কতটা জরুরি৷ একে আমাদের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির পূর্বশর্ত বলা যেতে পারে৷''
সিদ্ধান্তের রূপরেখা
সরকারের সামগ্রিক এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা বেশ কঠিন হবে, এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু তারপরেই প্রশ্ন ওঠে, কোন খাতে সরকার ব্যয় সঙ্কোচন করবে? কারা এর ফলে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে? যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশের মতো জার্মানিতেও ‘লবি'র অভাব নেই৷ সবারই মনে হয়, তার ক্ষেত্রে কোনো কাটছাঁট করা উচিত নয়, অন্য যাদের গুরুত্ব কম – তাদের জন্য বরাদ্দ অর্থ কাটতে পারে সরকার৷
জার্মান সরকার যেহেতু সাধারণ মানুষের কথা ভেবে আয়কর বা বিক্রয় কর বাবদ বাড়তি অর্থ আদায়ের পথে না যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাই অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি বরাদ্দ ও ভর্তুকি কাটতে হবে৷ জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি করলে তার ক্ষতিপূরণ বাবদ যে কর চালু রয়েছে, এতকাল কিছু ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম করা হতো৷ সেই ভর্তুকির যোগান দিত সরকারই৷ কঠিন এই অবস্থায় সেই ভর্তুকি তুলে দেওয়া হচ্ছে৷ বিমান সংস্থা ও পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিকে এবার থেকে সরকারি কোষাগারে মোটা টাকা জমা দিতে হবে৷ রেল সংস্থাকেও বাড়তি অর্থ গুনতে হবে৷ শেয়ার বাজারে আর্থিক লেনদেনের উপরেও করের বোঝা চাপানো হচ্ছে৷
প্রতিক্রিয়া
সাধারণ মানুষকে রেহাই দিয়ে শিল্প-বাণিজ্য জগতের উপর সরকারের এই বাড়তি চাপ সাধারণত সবার কাছেই বেশ গ্রহণযোগ্য মনে হয়৷ কিন্তু বিরোধী পক্ষ সরকারের এই পদক্ষেপে মোটেই সন্তুষ্ট নয়৷ এমনকি সরকারের ব্যয় সঙ্কোচ পরিকল্পনার খুঁটিনাটি বিষয়গুলি জানার আগেই তারা দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ঘোষণা করে৷ তাদের দাবি, সরকার সমাজের সংখ্যালঘু বিত্তবান শ্রেণীর উপর সামান্য কিছু আর্থিক বোঝা চাপিয়ে এমন সব খাতে আসল কাটছাঁট করছে, যার ফলে সাধারণ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ সামাজিক গণতান্ত্রিক দলের সভাপতি সিগমার গাব্রিয়েল বলেন, ‘‘এখানে যা তুলে ধরা হচ্ছে, তার পুরোটাই আসলে ফাঁপা৷ এর ফলে শ্রমিক-কর্মী ও পরিবারদের জন্য মারাত্মক চাপের সৃষ্টি হবে৷ এই কর্মসূচির মধ্যে কোনো স্পষ্ট নীতির প্রতিফলন নেই৷ কীভাবে জার্মানিকে সঙ্কট থেকে বার করা যায়, সেই পথ এখানে দেখানো হচ্ছে না৷ ৮ মাস ধরে দেশ শাসন করার পর জার্মান সরকার যা খাড়া করেছে, তা সত্যি অত্যন্ত দুর্বল৷''
শিল্প-বাণিজ্য জগতও সরকারের সিদ্ধান্তে খুশি নয়৷ তাদের বক্তব্য, বিশ্বায়নের এই যুগে জাতীয় পর্যায়ে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিলে তাতে মোটাই ফল হয় না৷ জার্মানির মতো দেশ এককভাবে আর্থিক লেনদেনের উপর কর বসালে জার্মানিতে ব্যবসা করাই কঠিন হয়ে পড়বে৷ তখন মূলধন এমন জায়গায় সরে যাবে, যেখানে এমন বাড়তি চাপ নেই৷
বিশেষজ্ঞরা আবার অন্য একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন৷ তাঁদের মতে, সরকারের ব্যয়-সঙ্কোচনের নীতির ফলে প্রায় সব মানুষই কোনো না কোনো ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ যারা হবে না, তাদের মনেও দুশ্চিন্তা দেখা দেবে৷ এমন অবস্থায় তারাও যদি পারিবারিক স্তরে ব্যয় সঙ্কোচন করা শুরু করে, তার সরাসরি প্রভাব পড়বে অর্থনীতির উপর৷ কেনাকাটা কমে গেলে বাজারে নতুন সমস্যা দেখা দেবে৷ থমকে যাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি৷
অর্থাৎ সরকার পড়েছে উভয় সঙ্কটে৷ বাজেট ঘাটতি সামাল না দিলে দেশের আর্থিক কাঠামো মারাত্মক সঙ্কটে পড়ে যাবে৷ সেই ঘাটতি মেটাতে দৃঢ় পদক্ষেপ নিলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষতি হবে৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ