বাক্সবন্দি
শুধু একটা স্টিলের বাক্স, কিন্তু তার কল্যাণে বিশ্ববাণিজ্যের চেহারাই বদলে গেছে, সম্ভব হয়েছে বিশ্বায়ন৷ বিশ্বের পণ্যের ৯৫ শতাংশই কোনো না কোনো সময় কনটেইনার হয়ে আসে৷
আবিষ্কারক
গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শেষদিক৷ ম্যালকল্ম ম্যাকলিন নামের এক মার্কিনি তাঁর তুলোর গাঁটগুলো বার বার তুলতে, নামাতে, প্যাক করতে করতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলেন৷ তখন তাঁর মাথায় আইডিয়া আসে: তুলোর গাঁটগুলো স্টিলের কনটেইনারে ভরে ট্রাকে বা জাহাজে তুলে পাঠালে কেমন হয়? সে কল্পনা বাস্তবে পরিণত করতে আরো বিশ বছর লেগে গিয়েছিল৷
সূচনায়
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি ম্যাকলিন (ছবিতে যাকে দেখা যাচ্ছে) তাঁর লরির বহর বেচে একটি ছোট শিপিং কোম্পানির দায়িত্ব নেন৷ একটি ট্যাংকার জাহাজের রদবদল করে তাতে নেওয়ার্ক থেকে হুস্টনে কনটেইনার পাঠানো হয় ১৯৫৬ সালের এপ্রিল মাসে৷ কনটেইনার শিপিং-এর সেই সূচনা৷ প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় উপকূল ধরেই কনটেইনার জাহাজ চলত, পরে তা সারা পৃথিবীতে চালু হয়৷
বড় বাক্সে, ছোট বাক্সে নয়
ক্রেট বা বাক্সে করে মাল পাঠানোর প্রথা আজকের নয়৷ ম্যাকলিনের ধারণার অভিনবত্ব ছিল সেই বাক্সের সাইজ৷ ১৯৬১ সালে বিশ্বব্যাপি কনটেইনারের সাইজ নির্দিষ্ট করা হয়: তথাকথিত ২০ ফুট কনটেইনার, পরিভাষায় যাকে বলে ‘টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট’ বা টিইইউ৷ জাহাজও মাপা হয় টিইইউ-তে৷
আইডিয়াটা সহজ, কিন্তু দারুণ!
সারা বিশ্বে একই সাইজের আধার চালু হওয়ার ফলে মাল একই কনটেইনারে প্রেরকের কাছ থেকে প্রাপক অবধি চলে যায়, যার ফলে পরিবহণের খরচাও কমে৷ আগে যেখানে ৮০ টন মাল নাড়চাড়া করতে ১৮ জন লোক লাগত, আজ ন’জন মাত্র মানুষ একের পর এক কাজ করে দু’হাজার টন মাল লোড করতে পারেন৷
সব কনটেইনার এক নয়
২০ টিইইউ-এর একটি কনটেইনারের আকার হলো কম-বেশি ছয় মিটার বাই আড়াই মিটার বাই আড়াই মিটার৷ এতে দশ হাজার জিন্স বা বিশ হাজার হাতঘড়ি ধরে৷ খাবারদাবার রাখার জন্য রেফ্রিজারেটেড বা হিমায়িত কনটেইনার আছে (যেমন ছবিতে); ট্যাংক কনটেইনারে তরল পদার্থ পরিবহণ করা চলে; আবার ভেন্টিলেটেড বা বাতাস যুক্ত কনটেইনারও আছে৷ একটি সাধারণ স্টিলের কনটেইনার বছর তেরো অবধি কাজ দেয়৷
ইউরোপের পথে
৬০ বছর আগে জার্মানিতে প্রথম কনটেইনার আসে৷ তারিখটা ছিল ১৯৬৬ সালের ৫ই মে: সেদিন ম্যাকলিন শিপিং কোম্পানির ‘ফেয়ারল্যান্ড’ জাহাজটি ১১০টি কনটেইনার নিয়ে ব্রেমেনে এসে পৌঁছয়৷ সবাই তখন ‘পাগল অ্যামেরিকান সাহেবের’ কথাই বলেছিলেন৷ আজ সেই কনটেইনার শিপিং ছাড়া দুনিয়া চলে না৷
বন্দরগুলো নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে
স্বভাবতই বন্দরগুলোকে কনটেইনার তোলা বা নামানোর জন্য কিছু কিছু রদবদল করে নিতে হয়েছে৷ গোড়ায় কোনো নির্ভরযোগ্য প্রণালী না থাকায় কনটেইনার অনেক সময় ‘হারিয়ে’ যেত – অর্থাৎ সেটা কোথায় রাখা হয়েছে, তা গোলমাল হয়ে যেত৷ পরে কনটেইনার ব্রিজ তৈরি হওয়ার ফলে তোলা-নামানোর কাজ অনেক সহজ হয়েছে৷ এছাড়া নতুন যে কনটেইনার শিপগুলো তৈরি হয়েছে, বন্দরে সেগুলোর জন্যও নোঙর ফেলার ব্যবস্থা রাখতে হয়েছে৷
ম্যাকলিনের ম্যাজিক
গোড়ায় জাহাজের মালিক থেকে শুরু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ, রেলওয়ে কোম্পানি বা শ্রমিক সংগঠন, সকলেরই আপত্তি ছিল৷ শ্রমিকদের ভয় ছিল, তাদের চাকরি যাবে, নয়ত নতুন সব ক্রেন, ট্রাক ও কনটেইনার নিয়ে কাজ করাটা অনেক বেশি শক্ত হবে৷ কিন্তু ম্যাকলিন তাদের সব ভয় দূর করতে সমর্থ হন৷ কনটেইনারের জনক যখন অবশেষে ২০০১ সালে পরলোকগমন করেন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর৷