ফ্রান্স-জার্মানি দারুণ খেলা
৪ জুলাই ২০১৪মারাকানায় জার্মানি বনাম ফ্রান্স কোয়ার্টার ফাইনাল৷ এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ঐতিহাসিক আঙ্গিকে স্থাপন করতে গিয়ে অনেকে নেপোলিয়ন থেকে আরম্ভ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আমলের ম্যাজিনো লাইন কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলের সিগফ্রিড লাইন এনে ফেলছেন: ভিচি ফ্রান্স, দ্য গল, নাৎসি অধিকৃত প্যারিস, নরমান্ডিতে মিত্রশক্তিদের অবতরণ, আরো কতো কী!
আসল কথা হলো, ফুটবলের ক্ষেত্রে দু'টি দেশের বৈরিতা কিংবা বৈপরীত্য কিছুটা পরোক্ষ: ফ্রানৎস বেকেনবাউয়ার আর মিশেল প্লাতিনির মধ্যে পার্থক্যটা যে রকম৷ জার্মানিতে ফুটবল ব্যাপারটায় সংগঠন বেশি, প্যাশন বা আবেগ কম – অন্তত ২০০৬ সালে স্বদেশে বিশ্বকাপ ও ইয়ুর্গেন ক্লিন্সমানের আমলের আগে তাই ছিল৷ অপরদিকে ফ্রান্সে প্লাতিনি অ্যান্ড কোম্পানির স্বর্ণযুগের পর ফুটবলের এক রাজপুত্তুর এসে ফ্রান্সকে জাতে তুলে দিয়ে যান: যাঁর কথা হচ্ছে, তিনি হলেন অবিস্মরণীয় জিনেদিন জিদান৷
ফ্রম জিদান টু বেনজেমা
অ্যালজেরিয়ার এক কিশোর – অবশ্যই ফ্রান্সে, মানে মার্সেইতে জন্ম – সে যে কি করে ফরাসি বিপ্লবে ফুটবল এনে ফেলল – মানে ফরাসি ফুটবলে বিপ্লব এনে ফেলল, সে কাহিনি নতুন করে শোনানোর প্রয়োজন নেই – অথবা আছে৷ কেননা করিম বেনজেমা-ও জাতিতে অ্যালজেরীয়, যদিও তাঁর জন্ম ফ্রান্সের লিয়ঁতে এবং বয়স জিদানের চেয়ে ১৫ বছর কম৷ হয়তো আরো একটা তফাৎ আছে: ‘নাথিং সাকসিডস লাইক সাকসেস' – সাফল্যের মতো আর কিছু সফল হয় না; তাই ফরাসি জাতি অদ্যাবধি ‘জিজু' বলতে পাগল৷ কিন্তু বেনজেমার প্রতি তাদের মনোভাব কিছুটা আলাদা৷ বেনজেমা নিজেই বলেছেন: তিনি যখন গোল করেন, তখন তিনি ফরাসি৷ আর তিনি যখন ফেল করেন, তখন তিনি অ্যালজেরীয়৷ অর্থাৎ যে ফরাসি দলকে দেখলে আজকাল আমার গিন্নি জানতে চান, ওটা আফ্রিকার কোন দেশ – সেই ফরাসি দলের আশা-ভরসা কিন্তু অনেকটা উত্তর আফ্রিকা এবং সাহারার দক্ষিণে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের উপর নির্ভর করছে৷ জার্মান দল সম্পর্কে যা বলা যায় না, একমাত্র জেরোম বোয়াটেং ছাড়া৷
ফার্স্ট বয়, লাস্ট বয়
অবশ্যই পরিসংখ্যান ঘাঁটলে বিশ্বকাপ পর্যায়ে দু'টি দেশের যাবতীয় মোলাকাত তথা সাফল্যে জার্মানি ফ্রান্সের চেয়ে এগিয়ে৷ বিশ্ব ফুটবল যদি ইস্কুলের কোনো ক্লাস হয়, তবে জার্মানি গাঁট্টা-গোট্টা একটা ভালো ছেলে, প্রায় সবসময়েই প্রথম আটজনের মধ্যে থাকে৷ সে তুলনায় ফ্রান্স একবার-দু'বার ফার্স্ট হয়ে পড়লেও, ফার্স্ট রাউন্ডে ধ্যাড়ানোতেও চ্যাম্পিয়ন৷ এক কথায়, জার্মান দল সবসময়েই ভালো এবং মাঝেমধ্যে খুবই ভালো৷ ফরাসিরা ভালো কিনা, সেটা ফরাসিরা নিজেরাই জানে না৷
যদি জানা সম্ভব হয়, তাহলে এবার, এই কোয়ার্টার ফাইনালে৷ এই ফরাসি দল এতোই ভীতিকর যে জার্মান দলের জেনারেল ম্যানেজার অলিভার বিয়ারহফ বলেছেন, এই মুহূর্তে তিনি ফ্রান্সকেই ফেবারিট বলে মনে করেন৷ আর কোচ ইওয়াখিম ল্যোভ তাঁর প্রতিপক্ষ তথা সতীর্থ সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘২০১০ সাল যাবৎ দিদিয়ের দেশঁ ফরাসি দলের মোড় ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং আমরা আরো একটা ক্ল্যাসিক ম্যাচ দেখার আশা করতে পারি৷''
‘দু'টি বই ল্যাজ মোর নাই রে'
ল্যোভের ক্ষেত্রেও সে কথা প্রযোজ্য, বিশেষ করে জার্মান দলে অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের অনবদ্য সংমিশ্রণটি তাঁর নিজের সৃষ্টি – সত্তরের দশকের জার্মান দলের অনুকরণে৷ নয়ত ল্যোভকে কতগুলো ছোটখাট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে: মারিও গ্যোৎসেকে এবার বাইরে রেখে গোড়া থেকেই ফরোয়ার্ডে আন্ড্রেয়া শ্যুর্লেকে খেলালে কেমন হয়? জার্মান ফুটবল বিশেষজ্ঞদের মতো জার্মান দলের গোলরক্ষক মানুয়েল নয়ার সহ একাধিক সতীর্থ চান যে, ক্যাপ্টেন ফিলিপ লাম-কে – আগের মতোই – ডানদিকে ফুলব্যাক হিসেবে খেলানো হোক৷
কিন্তু ল্যোভ লামকে মাঝমাঠে রাখার পক্ষপাতী, বিশেষ করে মাটস হুমেলস ফেরার ফলে যখন বোয়াটেং আবার ডানদিকে ঐ পোজিশনটি নিতে পারবেন৷ মেসুত ও্যজিল দৃশ্যত ফর্মে নেই এবং বোয়াটেং ও হ্যোভেডেস দু'জনেই আসলে সেন্টার-ব্যাক, যদিও তাদের উইং-ব্যাক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে: মিশায়েল বালাক, অলিভার কান এবং লোটার মাটেউস-এর মতো প্রাক্তন তারকারা এভাবে প্লেয়ারদের অনভ্যস্ত পোজিশনে খেলানোর সমালোচনা করেছেন৷ ল্যোভ অবশ্য বলতে পারেন: ‘অত পোজিশন-টজিশন নিয়ে ভেবে কী হবে? আমাদের মানুয়েল নয়ার আছে, সে এরপর মাঝেমধ্যে গোল ছেড়ে সামনে গিয়ে গোটা দু'য়েক গোল দিয়ে আসবে৷'
ঠাট্টা থাক৷ দিদিয়ের দেশঁকেও ভাবতে হবে, বেনজেমা এবং অলিভার জিরুর কম্বিনেশনটা ঠিকমতো কাজ করছে না কেন এবং গোড়া থেকেই জিরুর পরিবর্তে আঁতোয়ান গ্রিজমান-কে নামানোটাই কি সঠিক পন্থা? নয়ত মিডফিল্ডে ব্লেজ মাতুইদি-র অক্লান্ত পরিশ্রম এবং তরুণ প্রতিভা পোল পগবার অবশেষে ঝলসে ওঠার অপেক্ষা৷
এ এমন এক খেলা, যেখানে ফরাসি তরফে যারা মাঠে আছেন এবং জার্মান তরফে যাঁরা মাঠে নেই কিন্তু সাবস্টিটিউট হিসেবে আসবেন (মারিও গ্যোৎসে? মিরোস্লাভ ক্লোজে?), তাঁরাই জয়-পরাজয় নির্ধারণ করবেন – এই হলো আমার ভবিষ্যদ্বাণী৷
এসি/এসবি (ডিপিএ, এএফপি)