পাঠ্যবিষয় যখন যুদ্ধ
২১ জানুয়ারি ২০১৪
যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশে ইতিহাস কীভাবে পড়ানো হবে, যেখানে শিক্ষার্থী ও তাঁদের পরিবার পরিজন এর শিকার হয়েছেন? জার্মানির গেওর্গ একার্ট ইন্সটিটিউট ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসনিয়া-হ্যারৎসেগোভিনায় এই বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে৷ আজও বিষয়টিকে আয়ত্তে আনা শিক্ষকদের পক্ষে সহজ হচ্ছে না৷ যা শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের জন্য খুবই জরুরি৷
যুদ্ধ সম্পর্কে কথা
‘‘আমি ভূগোল ক্লাসে আমাদের দেশের সীমান্ত নিয়ে কীভাবে কথা বলতে পারি, যুদ্ধ সম্পর্কে কথা না বলে? বলেন সিবিলা জেভটিচ৷ ১৯৯৩ সাল বসনিয়া-হ্যারৎসেগোভিনার বেনইয়া লুকার স্কুলে ভূগোল ও ইতিহাস পড়ান তিনি৷ বসনিয়া-হ্যারৎসেগোভিনার উত্তাঞ্চলের এই শহরটিতে শিক্ষিকার নিজেরই গৃহযুদ্ধের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ তাঁর বাবা সার্বিয়ার পক্ষে চাচা ক্রোয়েশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করেছেন৷
‘‘আমার ছাত্র-ছাত্রীদের আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণনা করি আমি'', বলেন সিবিলা জেভটিচ৷ কিশোর ও তরুণদের অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধকে বুঝতে সহায়তা করেন তিনি৷ যুদ্ধ শুধু সাদা-কালো কোনো বিষয় নয়৷ সেই মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা ভোলার মতো নয়৷ আর এ কারণে যুদ্ধ নিয়ে পর্যালোচনা করাও খুব কঠিন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ৷ বলেন এই শিক্ষাবিদ৷ এ জন্য তিনি গেওর্গ একার্ট ইন্সটিটিউটের আন্তর্জাতিক পাঠ্যবই গবেষণা কেন্দ্রের সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি৷ এই ইন্সটিটিউট নতুন স্কুলের পাঠ্যবই ও সামগ্রী প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে গৃহযুদ্ধের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে৷
নতুন ইতিহাস পড়ানো
আমরা ২০০৮ সালে সর্ব প্রথম নতুন ইতিহাস পড়ানোর ঝুঁকিটা নিচ্ছি৷ বলেন প্রকল্পের সমন্বয়কারী কাটারিনা বাটারিলো হেনশেন৷ তবে বিতর্কিত বিষয়গুলি যেমন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, সেব্রেনিৎসার গণহত্যা ইত্যাদি তুলে ধরা হয়নি স্কুলের বইগুলিতে৷ প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে দৈনন্দিন জীবনের কার্যকলাপকে৷ কেননা যুদ্ধের সময় সার্বিয়ান, ক্রোয়েশিয়ান এবং বসনিয়ানদের দৈনন্দিন জীবনে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না৷ সংশ্লিষ্টদের ধারণা ছাত্র-ছাত্রীরা এই বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে আগ্রহী হতে পারে৷ অনেকেরই হয়ত সেই সময়কার কথা মনে আছে৷ কি কঠিন পরিস্থিতিতে তাদের স্কুলে যেতে হয়েছে, খাদ্য সংকটে পড়তে হয়েছে, বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় অন্ধকারে কাটাতে হয়েছে৷
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিদেশ দপ্তরের একটি প্রকল্পের আওতায় ব্রাউনশোয়াইগের এই ইনস্টিউট পাঠ্যবইতে যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে৷ যাতে বসনিয়ায় সিবেলার মতো শিক্ষকরা ছাত্রদের কাছে যুদ্ধের নানা দিকে তুলে ধরতে পারেন৷ এক্ষেত্রে বয়সের দিকেও লক্ষ্য রাখা হয়৷ বিভিন্ন বয়সের ছাত্রদের কাছে বিভিন্নভাবে তুলে ধরতে হয় বিষয়টিকে৷
দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ ছাড়াও বিশ্বের সংকটপূর্ণ দেশ যেমন বাল্টিক রাষ্ট্রগুলি, জর্জিয়া, বেলোরুশিয়া এবং ইউক্রেনের পাঠ্যপুস্তকেও যুদ্ধ বিগ্রহকে তুলে ধরার ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে এই ইন্সটিটিউট৷
‘পাঠ্য পুস্তক এবং সংকট'
যুদ্ধ পরবর্তী অঞ্চলগুলিতে সবাই মিলে একত্রে ইতিহাসকে পর্যবেক্ষণ করা খুব সহজ কাজ নয়৷ বলেন পাঠ্যপুস্তক গবেষক গেওর্গ স্ট্যোবার, যিনি ব্রাউনশোয়াইগ ইন্সটিটিউটের ‘পাঠ্য পুস্তক এবং সংকট' শাখাটি পরিচালনা করছেন৷ সব তরফেই পরস্পরের প্রতি নেতিবাচক ধারণা ও আঘাত অত্যন্ত গভীরে৷ স্ট্যোবার স্মরণ করে বলেন, এই প্রকল্পের শুরুতে বসনিয়ান, সার্বিয়ান ও ক্রোয়েশিয়ানরা ছোট ছোট দলে বসেছিলেন৷ এমনকি কফি বিরতিতেও পরস্পরের সঙ্গে কথা বলেননি৷ তবে সেমিনার চলাকালে ধীরে ধীরে তারা নিজেদের জাতিগত গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসেন৷ নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা নিজেদের পেশাগত পরিচয়কেই গুরুত্ব দিতে থাকেন৷
পাঠ্যপুস্তকের সংস্কার
২০০৩ সালে বসনিয়ায় পাঠ্যপুস্তকের সংস্কার শুরু হয়৷ বিশেষ করে বয়স্ক শিক্ষকদের অসুবিধা হয় যুদ্ধকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে৷ বলেন বারাটিলো হেনশেন৷ তাঁদের মনে এখনও কমিউনিস্ট আমলের শিক্ষক প্রশিক্ষণের ছাপ গেঁথে আছে৷ প্রথমে অনেকেই কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন৷ কেননা এই পদক্ষেপে তাঁরা শুধুমাত্র একটি ‘সত্যকেই' তুলে ধরতে পারবেন না, বরং একটি বিষয়কে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাতে হবে৷
পাঠ্যপুস্তক লেখক মেলিসা ফোরিকের মতে, বলকান যুদ্ধের নানা দিক বুঝতে হলে ক্লাসে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়াটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ৷ মেলিসা নিজেও ছোটবেলায় চার বছর ধরে চলা সারায়েভোর অবরোধ দেখেছেন৷ পাঠ্যপুস্তক সংস্কার কর্মসূচির শুরু থেকেই এই ইতিহাসবিদ অংশগ্রহণ করে আসছেন তাতে৷
তিনি বসনিয়ার সব ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অভিন্ন ইতিহাস বই চালু করার ব্যাপারে আগ্রহী ৷ তবে বাস্তব অবস্থা তাঁর এই ইচ্ছা থেকে অনেকটা দূরে৷ বলেন ফোরিক৷ ১৯৯৫ ডেটোন শান্তিচুক্তির ফলে বসনিয়া-হ্যারৎসেগোভিনা অনেকগুলি ক্যানটোনে বিভক্ত হয়ে যায়৷ ফলে ১৩টি শিক্ষামন্ত্রণালয়ের শিক্ষাবিভাগও অভিন্নতা হারায়৷