পশ্চিমবঙ্গে চাঁদাবাজিও এখন শিল্প
২৬ অক্টোবর ২০১৬চলতি বছরের জুন মাসে কলকাতার বিধান নগর উপনগরী থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের এক কাউন্সিলর তোলাবাজির দায়ে গ্রেপ্তার হয়৷ তারপর যা তথ্য বেরিয়ে আসে, তাতে বোঝা যায়, রাজনৈতিক শাসনের কত গভীরে ঢুকে বসে আছে ভয় দেখিয়ে টাকা তোলার এই অবৈধ কারবার৷ যেকোনো ব্যবসার মতোই তোলাবাজি বা চাঁদাবাজিও ফুলে ফেঁপে উঠেছে, উঠছে এই বঙ্গে৷ গ্রেপ্তার হওয়া ওই কাউন্সিলার, যিনি চলতি মাসে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন, তার রীতিমতো ‘রেট' বেঁধে দেওয়া ছিল৷ কোনো কাজের জন্য কত দিতে হবে৷ নিজের বাড়িতে যদি কেউ কোনো মেরামতি করতে চান, তা হলে এক রকম রেট৷ বাড়ির কোনো অংশের সম্প্রসারণ করতে চাইলে, তার রেট আলাদা৷ রাস্তায় যে লোকটি হয়ত চায়ের দোকান দিয়েছেন, বা ফলের ঝুড়ি নিয়ে বসেন, তাঁদেরও দৈনিক তোলা দিতে হতো ওই কাউন্সিলরকে৷ এবার বলাই বাহুল্য যে ওই তোলাবাজির টাকা রাজনৈতিক দাদা–দিদিদের বিভিন্ন স্তরে ভাগ হয়ে যেত৷ কোনো ব্যক্তিমানুষ একার জোরে এই কাজ বছরের পর বছর চালিয়ে গেছেন, এমনটা ধরে নেওয়া অবাস্তব৷ এবং এটাও বলা বাহুল্য যে প্রশাসনের একাংশের সমর্থন ছাড়া এই তোলাবাজি সম্ভব ছিল না৷ তাও হঠাৎ একদিন পুলিস তৎপর হয়ে পদক্ষেপ করল এবং ওই অভিযুক্ত কাউন্সিলরকে গ্রেপ্তার করল৷ তার একটাই কারণ- বিধান নগরের বাসিন্দা ওই কাউন্সিলর এমন একজনের থেকে টাকা দাবি করেছিল, যিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পূর্ব পরিচিত৷
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সচিবালয় থেকে সরাসরি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে ফোন করে অভিযোগ জানানো হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি৷
কিন্তু প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এই যোগাযোগ সবার নেই৷ ফলে লোকে মুখ বুজে তোলাবাজদের এই অত্যাচার সহ্য করে নেন৷ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যবসায়ীরা, যাঁরা কোনো দোকান, রেস্তোরাঁ, বা ওইরকম কোনো ব্যবসা চালান৷ বিধান নগরের ওই কাউন্সিলরের গ্রেপ্তারির সূত্রেই জানা গিয়েছিল, সরকারি বাজারের মধ্যে একজনকে তাঁর চুল কাটার সেলুনটি খুলতে দেওয়া হয়নি, কারণ, তিনি তোলা দিতে অস্বীকার করেছিলেন৷ একই কারণে চালু ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, পরে মোটা টাকা জরিমানা দিয়ে তোলাবাজদের সঙ্গে রফা করতে হয়েছে, এমন নজিরও আছে খাস কলকাতা শহরের বুকে৷
এ ধরনের ঘটনা যত শহর ছেড়ে মফস্বল, গ্রামের দিকে যাওয়া যায়, ততই বাড়ে৷ অবাধে যথেচ্ছ তোলাবাজি হয় হাইওয়েতেও৷ বিশেষ করে লরি ও ট্রাকচালকদের বহুদিনের অভিযোগ এই রাজ্যের তোলাবাজির বিরুদ্ধে৷ এবং সেটা যে শুধু গুন্ডা–মস্তানেরাই করে, তা নয়৷খোদ পুলিস প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রাস্তায় সার দিয়ে পণ্যবাহী গাড়ি দাঁড় করিয়ে, যানজট তৈরি করে, নজরানা আদায় করার৷ এর সঙ্গে আছে উৎসবের মরশুমে হাইওয়েতে চাঁদার উৎপাত৷ দুর্গা, বা কালীপুজো থেকে শুরু করে শনি, মনসা, যে কোনও ছুতোয় চাঁদা তোলে স্থানীয় লোকজন, যাদের সঙ্গে পুজোর কোনো সম্পর্কই নেই৷ একাধিক ক্ষেত্রে পুলিশ এই চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে দেখেছে, পুজোর ব্যাপারটাই ভুয়ো, আসল ধান্দা লোকের থেকে জোর করে টাকা তোলা৷ বহু ছোটখাট গুন্ডা–মস্তানের, পাড়ার বখাটে ছেলেদের হাতখরচ চলে এভাবেই৷
এমন ভেবে নেওয়াটা ভুল হবে যে তোলাবাজির এই জুলুম বর্তমান সময়েরই সমস্যা৷ পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের আমলেও এই তোলাবাজি ছিল, এমনকি তারও আগে যে কংগ্রেস সরকার, সেই আমলেও সত্তরের দশকে এ রাজ্যে কুখ্যাত সব তোলাবাজদের রমরমা ছিল৷ বাম আমলেও তার কিছুমাত্র পরিবর্তন হয়নি,
এই পরিবর্তনের জমানাতেও কোনো একটি জিনিস যদি অপরিবর্তিত থাকে, তা হলো তোলাবাজি৷ প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা, ক্ষেত্রবিশেষে প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন সমর্থনও এই তোলাবাজিকে চাঙ্গা রেখেছে বছরের পর বছর৷ বিধাননগরের ওই কাউন্সিলর গ্রেপ্তার হওয়ার পর দৃশ্যতই অপ্রস্তুত, বিব্রত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তোলাবাজ এবং সিন্ডিকেটরাজের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ প্রায় ১০ হাজার সন্দেহভাজন, অভিযুক্তকে আটক করেছিল পুলিশ৷ কিন্তু তাতে সমস্যার মূলে যে পৌঁছনো যায়নি, তার উদাহরণ সাম্প্রতিক সময় রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় বেপরোয়া তোলাবাজির অজস্র অভিযোগ৷ রাজনীতির দূর্বৃত্তায়ন যতদিন না বন্ধ হচ্ছে, ততদিন যে এমনটাই চলবে, এ নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই!
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? জানান নীচে মন্তব্যের ঘরে৷