দুনিয়ার বাস্তুহীন এক হও! দখল কর!
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০প্যারিসের বাস্তু-আন্দোলনকারীরা বলছেন, এমন অবস্থায় তারা একটাই কাজ করতে পারেন, আর তা হল ফাঁকা জায়গা পেলেই সেখানে থাকতে শুরু করা৷ এমনকি প্রয়োজনে অনুমতির তোয়াক্কা না করে ‘স্কোয়াটিং' বা জবরদখল করা৷ তাদের যুক্তি, শত শত বাড়ি পরিত্যক্ত পড়ে থাকবে আর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায়-পার্কে ঘুমোবে এমন সমাজে জবরদখলে কোনো দোষ নেই৷
এটা সবাই জানে যে, প্যারিসে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া কি ভীষণ ঝক্কির ব্যাপার আর সেজন্য কতো আর্থ-সামাজিক বাধা পেরিয়ে কতো কাঠখড় পোড়াতে হয়৷ এটা অকল্পনীয় রকমের কঠিন যদি আপনার আর্থিক অবস্থা খুব ভাল না থাকে আর আপনি কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ হলে তা বলতে গেলে অসম্ভব৷ ফরাসি আলজেরীয় লেখিকা ফায়জা গেনে এভাবেই প্যারিসের আবাসিক সংকট ব্যাখ্যা করছিলেন৷ ফায়জা বলেন, ‘‘আপনি সংখ্যালঘু হলে অনেক আবাসন সংস্থার এজেন্টরা আপনাকে বাসা দেখার সুযোগ দেওয়া তো দূরে থাক আপনার ফোন কলই ধরবে না৷''
ফায়জার পরামর্শ, আপনি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে বাসা খোঁজার অপেক্ষায় থাকেন তাহলে সেই চিন্তা বাদ দিয়ে প্রতিবছরই অনেক ছাত্রছাত্রীরা যেমন করে থাকে, তেমনি আপনারও কোনো একটা তাঁবুশিবিরে গিয়ে আশ্রয় নেওয়াই ভাল৷ আর যখন আপনি জানবেন যে, একজন শিক্ষার্থীর বাজেটের ৬০ ভাগই চলে যায় বাসা ভাড়া দিতে তখন অবশ্য আপনাকে এতোকিছু বোঝাতে হবে না বলেই ধারণা এই লেখিকার৷
ফায়জা তার নিজের ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতার উদাহরণ দেন৷ তিনি জানান, ১৭ বছর বয়সে লেখাপড়া করার উদ্দেশ্যে প্যারিসে রওনা হওয়ার সময়ে তার মা'র বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে তিনি কখনোই সেখানে থাকার জায়গার ব্যবস্থা করতে পারবেন না৷ আদতে হয়েছিলও তাই৷ ফলে ফায়জাকে লেখাপড়া করতে হয়েছি ব্রিটানিতে গিয়ে৷
এই লেখিকা বলছিলেন, ‘‘আমাদের কোনো আত্মীয় বা বন্ধু ছিল না যাদের বাড়িতে ভাড়া থাকা যায়৷ আর সবচেয়ে বড় কথা আমার মায়ের এমন সামর্থ্য ছিল না যে প্রতিমাসে বাড়িভাড়া দেওয়ার বিষয়ে বাড়িওয়ালাকে একটি কাগুজে নিশ্চয়তাপত্র সরবরাহ করতে পারেন তিনি৷ আমার কথা হাস্যকর শোনাতে পারে, কিন্তু এটাই সত্যি৷ প্যারিসের বেশিরভাগ বাড়িওয়ালাই শুধু যে এককালীন মোটাসোটা জামানত চান তা নয়, তারা একইসঙ্গে অভিভাবক বা অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে এ বিষয়ে নিশ্চয়তার আইনি কাগজপত্রও দাবি করে থাকেন৷''
প্যারিসে তরুণ তরুণীদের আবাসন সংকটের অন্যতম বড় বাধা বাড়িওয়ালাদের এই দাবির পাহাড়৷ এছাড়া সরকারি বিকল্পও অত্যন্ত সীমিত৷ প্যারিসে বৃত্তি নিয়ে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৩,৫০,০০০ হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণাধীণ ছাত্রাবাসের মোট কক্ষের সংখ্যা মাত্র ৩০,০০০৷
নিরুপায় ছাত্রছাত্রী এবং দরিদ্র কর্মজীবীরা এই পরিস্থিতিতে বেছে নেন অন্য বিকল্পগুলো৷ যেমন - বয়স্কদের সাহায্য করার বিনিময়ে সস্তায় ঘরভাড়া দিয়ে থাকা, সাবলেট করা, আত্মীয়দের সঙ্গে থাকা কিংবা জবরদখলের আশ্রয় নেওয়া৷ এমনকি, অনেক নারী এই পরিস্থিতিতে ‘বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে' সুযোগসন্ধানী পুরুষদের গৃহসঙ্গীও হয়ে যান৷ অর্থাৎ, বাধ্য হয়ে যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন৷
প্যারিসের এই তীব্র আবাসন সংকট থেকেই জনপ্রিয় হয়েছে বাস্তু-অধিকার গ্রুপ ‘জ্যদি নোয়ার'৷ যারা ‘স্কোয়াটিং' বা জবরদখলকে সমর্থন করে আসছেন এবং বিষয়টিকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ ফ্রান্সে ‘পিএপি' বা সাপ্তাহিক ক্লাসিফায়েড বাড়িভাড়ার বিজ্ঞাপন প্রকাশের দিন বৃহস্পতিবার৷ এইদিনকে ‘কৃষ্ণ বৃহস্পতি' নামে আখ্যা দিয়েই ওই গ্রুপ নিজেদের নাম রেখেছে ‘জ্যদি নোয়ার' বা ‘কৃষ্ণ বৃহস্পতি'৷
সম্প্রতি প্যারিসের এক বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স সাময়িকভাবে দখল করে নিয়ে আলোচনায় আসে এই ‘কৃষ্ণ বৃহস্পতি' গ্রুপ৷ ৮৭ বছর বয়সি ফরাসি ধনকুবের বিয়াত্রিস কোত্যাঁ'র ১,৩০০ বর্গমিটারের বাড়িটি প্রায় আড়াই মাস দখল করে রাখে এই সংগঠনের আন্দোলনকর্মীরা৷ একসময়ে অনেক নামকরা ব্যক্তির আবাসস্থল হিসেবে বিখ্যাত বাড়িটি গত প্রায় চারদশক ধরে খালি অবস্থায় পড়ে ছিল৷ পুলিশের বাধার মুখে শেষ পর্যন্ত উচ্ছেদ হতে হলেও তাদের প্রচারণা সফল হয়েছে৷ শুধু যে ওই বাড়িটিই তারা জবরদখল করেছিল তাই নয়, মাঝে মধ্যেই নানা পরিত্যক্ত সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়ি, অফিস ভবন বা অন্যান্য স্থাপনাতেও হানা দেয় তারা৷ এই দখল সাময়িক হলেও মূল লক্ষ্য প্রচারণা৷
এই অভিযানে তাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল দেশবাসীকে এটা জানানো যে, প্যারিসের প্রতি ১০টি বাড়ির ১টি পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে৷ যেখানে খোদ প্যারিসের মেয়র বলছেন, শুধুমাত্র প্যারিসেই ১৬,০০০ এমন বাড়ি আছে যা কিনা দেশের পরিত্যক্ত সম্পত্তি আইনে দখলে নিতে পারে সরকার৷
বাস্তু-আন্দোলনকারীদের দাবি সরকার চাইলেই ভাল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এগুলোর সদ্ব্যবহার করতে পারে৷ এই প্রচারণায় যোগ দিয়ে সেখানে ছাত্রছাত্রী এবং তরুণ তরুণীদের সঙ্গে আবাস পেতেছিলেন অনেক পেশাজীবীও৷ যাদের মধ্যে আছেন স্থপতি, সাংবাদিক এমনকি ভায়োলিন বাদকও৷ এদের অনেকের আবাসন সংকট না থাকলেও বিষয়টিকে গণমাধ্যমের পাদপ্রদীপে আনার জন্যই এই জবরদখলকারীদের দলে যোগ দিয়েছিলেন তারা৷ আর সবাই মিলে শ্লোগান ধরেছিলেন, ‘‘দুনিয়ার বাস্তুহীন এক হও! দখল কর!''
প্রতিবেদক: মুনীর উদ্দিন আহমেদ
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক