1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তারুণ্যের কৃষি বিপ্লব

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৯ নভেম্বর ২০১৬

রাজবাড়ির ক্ষুদ্র কৃষক আব্দুল আজিজের ছেলে আমিরুল ইসলাম আমির৷ এখন মাস্টার্স করছেন ঢাকা কলেজে৷ কোনো চাকরির কথা না ভেবে ইতিমধ্যে কৃষিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তিনি৷ এমন তরুণদের হাত ধরেই যেন শুরু হয়েছে কৃষি বিপ্লব৷

https://p.dw.com/p/2TIK2
Bildergalerie Mangos in Bangladesch
ছবি: DW/M. Mamun

আমিরুল ইসলাম আমির ডয়চে ভেলকে বলেন, ‘‘বাবা দরিদ্র কৃষক৷ তাঁকে তার কৃষিকাজে সহায়তা করতে গিয়েই আমার এই কৃষির প্রতি আগ্রহ৷ আমাদের বসতবাড়ি ও ২০ শতক জমিতে এখন নানা ধরণের ফসল ফলাচ্ছি৷ কলা, টমোটো, পিঁয়াজ, হলুদ, সব্জি চাষ করেছি৷ ধানচাষে আমি সফলভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে সম্বর্ধনাও পেয়েছি৷ তারা আমাকে উৎসাহিত করছেন৷ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন৷''

নিজেদের পর্যাপ্ত কৃষি জমি না থাকায় আমির জমি বর্গা নেন৷ তারপর চাষ করেন৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আমি এরই মধ্যে  কৃষির ওপরে প্রশিক্ষণ নিয়েছি৷ ফলে আমি বীজ, সার ব্যবহারে সঠিক কৌশল জানি, ফলে আমার উৎপাদন বেশি৷ আমি তাই আরো কুষকের সঙ্গে কথা বলছি৷ তাঁদেরও পরামর্শ দিচ্ছি৷ আমি চাইছি পাশাপাশি খন্ড খন্ড জমি একই চাষের আওতায় আনতে৷''

তরুণ এই কৃষক আরো বলেন, ‘‘কৃষিতে আমার এই অংশ গ্রহণ আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি ঘটিয়েছে৷ কিন্তু আরো বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন৷ আমি আধুনিক কৃষি ফার্ম গড়ে তুলতে চাই৷ চাই পুরোপুরি আধুনিক পদ্ধতিতে কুষি উৎপাদন এবং বিপণন৷ সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি৷''

চুয়াডাঙ্গা সদরের তরুণ আলিমুজ্জামান ও ফিরোজুল হক এরকমই আরো দু'জন উচ্চ শিক্ষিত তরুণ৷ আলিমুজ্জামান ঢাকার নর্দান  ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ শেষ করেছেন আর ফিরোজুল হক স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন৷ তাঁরা দু'জন মিলে অংশীদারিত্বে ১০ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন তাঁদের কৃষি খামার৷ তাঁরা সেখানে উৎপাদন করছেন মৌসুমি ফল ও শাকসবজি৷ 

A K S Mursed - MP3-Stereo

আলিমুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘কৃষি আমাদের পারিবারিক ব্যবসা৷ বাবা মারা যাওয়ার পর তাই আমাকে হাল ধরতে হয়৷ কিন্তু আমরা কৃষিতে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছি৷ আমরা উন্নত সার, বীজ আমদানি করে ব্যবহার করেছি৷ আমরা থাইল্যান্ড ও ভারতে গিয়ে আধুনিক কৃষি পদ্ধতি দেখে এসেছি৷ পরামর্শ নিচ্ছি কৃষিবিদদের৷''

তবে তাঁরা এখন কৃষির বিপণন নিয়েও ভাবছেন৷ চিন্তা করছেন ডাইরেক্ট মার্কেটিংয়ের কথা৷ আর এটা করতে গিয়ে তাঁরা কৃষকদেরও সংগঠিত করছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন৷ আলিমুজ্জামান বলেন, ‘‘আমরা কৃষকদের কাছ থেকেও তাঁদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য কিনে সরাসরি বাজারজাত করতে চাই৷ আর তা করতে পারলে কৃষক আগের চেয়ে বেশি দাম পাবেন৷''

বাংলাদেশে অর্গানিক কৃষিপণ্যের মান নির্ধারণের কোনো ব্যবস্থা নেই৷ তারপরও অর্গানিক কৃষিপন্য উৎপাদনের প্রচেষ্টা রয়েছে তাঁদের৷ আলিমুজ্জামানের ভাষায়, ‘‘আমরা যদি সুস্থ থাকতে চাই, ভালো ভালো খাবার খেতে চাই, এটা শুধু বললেই তো হবেনা, উৎপাদনটাও আমাদের করতে হবে৷''

এটা বলতে গেলে পুরো বাংলাদেশের চিত্র৷ তরুণ এবং শিক্ষিত তরুণরা পুরো বাংলাদেশের কৃষির চিত্র পাল্টে দিচ্ছে৷ যেমন দক্ষিণের জেলা পিরোজপুরের তরুণরা সমতল ভূমিতে মাল্টা চাষে সফল হয়েছে৷ ঢাকার অদূরে সাভার ও কালিয়াকৈরে সবজি চাষে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে তরুণরা৷ রাজশাহীতে আম আর ধানচাষে তাঁরা সূচণা করেছেনন নতুন দিগন্তের৷ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে তরুণরাই এখন কৃষির প্রাণ৷ এখন কৃষিকাজে জড়িতদের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সি তরুণ৷

সেরককমই আরেক তরুণ রাজশাহীর বাঘা উপজেলার অমলপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলম হোসেন৷ তিনি পাঁচ বছর আগে এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ফিলোসফিতে স্নাতক ও মাস্টার্স শেষ করার পর চাকরির জন্য ঘুরেছেন৷ চাকরি পেয়েছেনও, কিন্তু মনের মতো নয়৷ তাই চাকরি না করে বাবার সঙ্গেই পারিবারিক কৃষিকাজ শুরু করেন৷ তিনি এখন একজন সফল এবং ধনী কৃষক৷ তাঁর রয়েছে উন্নত জাতের ধানের চাষ, আম বাগান আর মাছের চাষ৷ তাঁর কৃষি ফার্মে এখন পূর্ণকালীন ২৭ জন কর্মচারী আছেন৷ আর এই কৃষকের মূল মন্ত্র আধুনিকতা ও নতুনত্ব৷ আলম হোসেন ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এবছররই আমি আম চাষে ট্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহার করি৷ ট্যাগিং পদ্ধতি হলো, আমের মুকুল থেকে গুটি আসার ৪০ দিনের মধ্যে এক ধরণের বিশেষ পলিথিনে আম ঢেকে দেয়া৷ এর ফলে আম পোকা বা বালাইমুক্ত রাখতে কোনো কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না৷ কীটনাশকমুক্ত আম, ফরমালিনমুক্ত আম হয়৷আমার আম এখন ইউরোপে রপ্তানি হয়৷''

Alimuzzaman - MP3-Stereo

তিনি আরো বলেন, ‘‘ধান চাষের ক্ষেত্রে আমি উন্নত বীজ ও আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করি৷ কৃষি অফিস কোনো উন্নত জাত উদ্ধাবন করলে আমাকে বীজ দেয় বিনামূল্যে৷ আর আমি ফসল উৎপাদন করে পরে তাদের বীজ ফেরত দিই৷ কৃষকদের আমি নিয়মিত পরামর্শ দেই৷ আর নিজে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিই৷''

প্রশ্ন করেছিলাম, ‘‘চাকরি না করে কৃষক হয়ে ভুল করেননি তো?'' জবাবে বলেন, ‘‘ভুল করিনি, সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ এখন আমার যে সচ্ছলতা তা কোনো চাকরি দিয়েই সম্ভব ছিল না৷ আমার নিজের সিংহাসনে আমি নিজেই রাজা৷''

বাংলাদেশ পল্লী ও কর্মসংস্থান ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) কৃষিক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ সহায়তা দেয়৷ এ পর্যন্ত তারা ২২ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষি উদ্যোগকে ঋণ সহায়তা দিয়েছে৷ তাদের মধ্যে তিন লাখ উদ্যোক্তা আছেন, যারা বয়সে তরুণ এবং নতুন ধরণের কৃষিপণ্য এবং ফসল উৎপাদনে যুক্ত হয়েছেন৷

তরুণরা গোলমরিচ, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ, টমেটো, ড্রাগন, স্ট্রবেরি মাল্টা ও কমলা ফলের মতো নিশ্চিত মুনাফা আছে এমন খাতগুলোতে বিনিয়োগ করছেন৷ তারা কৃষিপণ্য বিপণন এবং কৃষিযন্ত্রপাতির ব্যবসায় এগিয়ে আসছেন৷ তারা মৎস চাষ ও হাস-মুরগী চাষেও এগিয়ে যাচ্ছেন৷

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘‘এখন যারা কৃষিকাজ করেন, তাদের ১৫ থেকে ২০ ভাগ শিক্ষিত৷ আর কৃষি বলতে ধান চাষ বা পাট চাষ বুঝায় না, এর গন্ডি অনেক বড়৷শিক্ষত তরুণরা কৃষিতে প্রবেশ করায় এই খাতটা নতুন রূপ পাচ্ছে, কারণ, নানা সূত্র থেকে সে কৃষি বিষয়ক তথ্য যোগাড় করতে পারে৷ তার কাছে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার কৃষির খবর আছে৷ সে সহজেই নতুন কিছু গ্রহণ এবং প্রচলন করতে পারে৷ আর এ কারণেই বাংলাদেশের তরুণদের হাত দিয়ে এখন এখানে দক্ষিণ আফ্রিকার বিশেষ ধরণের কমলা ম্যান্ডরিনের চাষও হচ্ছে৷''

Alom Hossain - MP3-Stereo

তিনি আরো বলেন, ‘‘তরুণরা বুঝতে পেরেছে কৃষি একটি অর্থকরী খাত৷ তাই সে কর্মসংস্থানের জন্য এই খাতকে বেছে নিয়ে তার উদ্ভাবনী জ্ঞান কাজে লাগাচ্ছে৷ মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হচ্ছে৷ আর তরুণরা সেই জায়গা ধরে নতুন ফসল ও ফলের উৎপাদনে যাচ্ছে৷'' 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ হলো, এখন কৃষিকাজে এই তরুণরা সাধারণভাবে প্রচলিত কৃষি নয়, তারা যা করেন, তা ব্যতিক্রমী কিছু৷ তাদের বেশিরভাগই ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী৷ তারা কৃষিতে নতুন ধারার সৃষ্টি করছেন৷ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, কৃষিবিদ মো. হামিদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কৃষি জটিল এবং বাণিজ্যিক হচ্ছে৷ কৃষি এখন অর্থ আয়ের খাতে পরিণত হচ্ছে, যা তরুণদের আকৃষ্ট করছে৷ এটা কৃষির একটি ঐতিহাসিক বাঁক পরিবর্তন৷ এটা হতেই হবে৷ পুষ্টিকর এবং নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে৷ আর তা দিতে পারে কৃষি৷ তার জন্য প্রয়োজন আধুনিক জ্ঞানসম্পন্ন কৃষক৷ তরুণরাই সেই জায়গা নিচ্ছে৷ তারা কৃষিকে দেখছে বাণিজ্যিক দিক থেকে৷ আর এরাই বাংলাদেশের কৃষিকে নতুন জায়গায় নিয়ে যাবে৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘কৃষিপণ্যের চাহিদা সবখানেই বাড়ছে৷ আর তা সম্ভাবনার নতুন নতুন দুয়ার খুলে দিচ্ছে৷ তরুণরা সেটা বুঝতে পারছে৷''

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এর মহাপরিচালক কে এস মুর্শিদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তরুণরা উদ্যমী এবং সৃজনশীল৷ তারা কৃষিখাতে আধুনিক পদ্ধতি এবং যন্ত্রপাতি নিয়ে আসছে৷ তারা প্রচলিত ধারার কৃষি নয়, নতুন ধারা এবং নতুনত্বে বিশ্বাসী৷ ফলে তারা প্রচলিত কৃষিকে আধুনিক রূপ দিচ্ছে৷ কৃষিকে তারা দেখছে বিনিয়োগ হিসেবে৷ আর তারা আত্মপ্রকাশ করছে  উদ্যোক্তা হিসেবে৷''

অন্য  এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘ দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে৷ সেই হারে প্রচলিত ধারার চাকরি বাড়ছেনা৷ একই সঙ্গে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান কমছে৷ দেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বড় একটি অংশই গ্রামের, কৃষকের সন্তান৷ তাই তারা এখন আর অযথা চাকরির পিছনে না ছুটে কৃষিতেই নতুন চিন্তা আর উদ্যোগ নিয়ে ফিরে যাচ্ছে- যা আশাব্যঞ্জক৷''

DR Asaduzzaman - MP3-Stereo

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব মতে বাংলাদেশ চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, সব্জি চাষের জমি বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে প্রথম আর উৎপাদন বৃদ্ধির হারে তৃতীয়৷ স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সবজি উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ৷ ফল উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে৷ আর এসব সাফল্যের ধারায় তরুণদের অংশগ্রন নতুন মাত্রা যোগ করছে বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা৷

বাংলাদেশের তারুন্যনির্ভর এই কৃষিব্যবস্থা যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ফল, তা কিন্তু নয়৷ বিশ্লেষকরা মনে করেন, কৃষিতে নানা ধরণের সহায়তা বাড়ছে, ঋণের সুযোগ বেড়েছে, বেড়েছে কৃষি সহায়তা, তারপরও শিক্ষিত তরুণরা তাদের কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র খুঁজতে গিয়ে কৃষিতে আত্মনিয়োগ করে সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে৷ আর তা আরো তরুণকে এই খাতে আসতে উৎসাহিত করেছে৷ তাঁরা মনে করেন, কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক৷ এরসঙ্গে আধুনিক যোগাযোগ, তথ্য প্রযুক্তি এবং গণমাধ্যম অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে৷ আর এই অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের কৃষি নতুন যুগে প্রবেশ করবে৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান