টাখেলেসের বাঁচার যুদ্ধ
২৫ অক্টোবর ২০১০বছরে প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ হবেন, যারা এই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাড়িটি দেখতে আসেন৷ বার্লিনের এ'বাড়িটি একসময় একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল৷ যুদ্ধের ডামাডোলের পর বিশেষ করে বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর এটি যেন ক্রমশ এক শিল্পের সূতিকাগারেই রূপ নিয়েছিল৷ টাখেলেসে গড়ে উঠেছিল প্রায় সত্তর জন শিল্পীর একটি অসাধারণ স্টুডিও কমপ্লেক্স৷
ত্রিশটি স্টুডিও গড়ে উঠেছে সেখানে৷ শিল্পীদের কেউ ভাস্কর, কেউ আলোকচিত্রী৷ ভাবা যায়! একই চৌহদ্দিতে এ যেন এক অনন্য সৃষ্টিশীলতার মেলা৷ ঠিক যেন এক স্মৃতিমেদুর শিল্পের প্রাণোচ্ছল গর্ভগৃহই হয়ে উঠেছিল এই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাড়িটি৷ নব্বই দশকের গোড়ার দিকে, ‘বার্লিন ওয়াল' পতনের ঠিক পরপরই একদল শিল্পী ইহুদী সিনাগগের কাছে, ওরানিয়েনবুর্গারস্ট্রাসেতে অবস্থিত এই পোড়ো বাড়িটির দখল নিতে সচেষ্ট হন৷ একসময় নাৎসিরা ফরাসি যুদ্ধবন্দিদের এখানে আটকে রাখতো৷ শিল্পীরা পোড়ো বাড়িটির দখল নিয়ে এর নাম রেখেছিলেন - টাখেলেস, যার অর্থ হচ্ছে- সরাসরি কথা বলা৷
তাঁদের এই সাহসী পদক্ষেপ সেই আলুথালু টালমাটাল সময়টিতে নিজেকে গোছাতে বার্লিনকে সাহস যুগিয়েছিল৷ টাখেলেস খুব দ্রুত বিদেশি পর্যটক, ভবঘুরেদের দল, পড়তে আসা ছাত্রদের উষ্ণ ভীড়ে প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠলো৷ সবাই এখানে আসতো, শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলতো৷ তাঁদের সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা পদশব্দে মুখরিত থাকতো টাখেলেসের গ্রাফিতি ভরা দেয়াল৷ অল্প সময়ের মধ্যেই পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হল টাখেলেস৷
কিন্তু টাখেলেসের আয়ু কমে এসেছে বলেই মনে হচ্ছে৷ সম্প্রতি হামবুর্গের রাস্ট্রীয় মালিকানাধীন এইচএসএইচ নর্ড ব্যাংক জানিয়েছে, তারা এই বাড়িটিকে নিলামে তুলতে যাচ্ছে৷ কারণ হিসেবে ব্যাংক জানিয়েছে, ঋণে ডুবে থাকা এর মালিকের পক্ষে আর টাখেলেসের বোঝা টানা সম্ভব হচ্ছে না৷ ৭০ মিলিয়ন ইউরোর ঋণে তিনি আকন্ঠ নিমজ্জিত৷
কিন্তু বার্লিনের একেবারে ঠিক বুকের ওপরে, প্রায় ২৩ হাজার বর্গমিটারের এই ঐতিহাসিক জায়গাটিতে যারা অলাভজনক আর্টহাউজটি চালাচ্ছেন, তারা এই নিলামের খবরে রীতিমত স্তম্ভিত৷ খোদ বার্লিনের প্রশাসনও এই ঐতিহাসিক আর্ট হাউজটিকে বাঁচাতে চাইছেন৷ কেননা এটি বার্লিন এর জন্য যুদ্ধের স্মৃতিবহ এক অন্যতম স্মারক৷
পঞ্চাশের দশকের শিল্পী আডলার৷ তিনি জানিয়েছেন, ইতিহাসে বহুবারই নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে টাখেলেস, বহু দুর্দিনই গেছে, আজ আবারো তাকে বাঁচাতে সাহায্য প্রয়োজন৷ এ শুধু বার্লিনের জন্যই নয় বরং গোটা বিশ্বের শিল্পের প্রয়োজনেই টাখেলেসকে রক্ষা করা দরকার৷
বার্লিনের মেয়র ইতোমধ্যেই হামবুর্গের মেয়রকে অনুরোধ করেছেন যাতে এইচএসএইচ ব্যাংক টাখেলেস নিয়ে তাদের এই নিলামের পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন না করে৷
বার্লিনের সংস্কৃতি বিষয়ক সচিব আন্দ্রে শ্মিৎস বলেছেন, টাখেলেসকে রক্ষা করতে হবে৷ আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি যাতে এর শিল্পীরা সেখানেই থাকতে পারেন৷ টাখেলেসের এক মুখপাত্র লিন্ডা সেরেনা বলেছেন, আমরা যদিও চাপের মধ্যে আছি৷ কিন্তু টাখেলেস রক্ষার আইনানুগ সমস্ত চেষ্টাই আমরা করবো৷ উল্লেখ্য, টাখেলেস রক্ষার প্রচেষ্টা হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন অংশের প্রায় পঁচাশি হাজার মানুষের স্বাক্ষর ইতোমধ্যেই সংগৃহীত হয়েছে৷
টাখেলেসের এই নিলাম ঠেকাতে পঁচাশি হাজার মানুষ ইতোমধ্যেই স্বাক্ষর করেছেন, হয়তো সামনে আরো লক্ষাধিক মানুষ টাখেলেস রক্ষার এই মানবিক আবেদনে স্বাক্ষর করবেন৷ বিশ্বযুদ্ধে বোমারু বিমানের নির্মম আঘাত সয়েও টাখেলেস টিকে ছিল৷ নতুন করে প্রাণে স্ফূর্তিতে জেগে উঠেছিল ফিনিক্সের মত, আজ পারবে কি?
প্রতিবেদন: হুমায়ূন রেজা
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক