গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০গ্রিসের এই অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়েছে ইউরো মুদ্রার ওপর৷ সম্প্রতি ব্রাসেলস সম্মেলনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা একবাক্যে জানিয়ে দিয়েছেন, এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে গ্রিসকে তার ঘাটতির মোট জাতীয় উৎপাদনের অন্তত ৪ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে৷ এর মূল কারণ হিসেবে তাঁরা জানান, ইউরোর ওপর এর প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচক হতে পারে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থমন্ত্রীরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, গ্রিসের এই সংকটের তীব্র প্রভাব পড়তে পারে ইউরোর ওপর৷ ইউরোপীয় অর্থনৈতিক ও অর্থ পরিষদ একোফিনের সিদ্ধান্তের উল্লেখ করতে গিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক বিষয়ক কমিশনার অলি রেন জানান, ‘‘একোফিন এই প্রস্তাব অনুমোদন করেছে যে, বাজেট ঘাটতি এবং ঋণের কারণে যে ঝুঁকির সম্ভাবনাগুলো রয়েছে তা আটকাতে গ্রিসকে মার্চ মাসের মাঝামাঝি ব্যয় হ্রাসের অতিরিক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে৷''
চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে গ্রিসকে বাজেট ঘাটতির প্রায় ৪ শতাংশ কমাতে হবে৷ এছাড়া এথেন্স সরকারকে দেশের জাতীয় আয় বাড়াতে হবে৷ আয়কর, খাজনা, গ্যাস, পানির বিল সবকিছুই বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে ব্রাসেলস৷ গ্রিসের স্টক এক্সচেঞ্জের দিকেও নজর রাখা হবে বলে জানানো হয়েছে৷ ইউরো ব্যাংকের কর্মকর্তা গিকাস হার্দোভেলিস জানান, ‘‘গ্রিসের অর্থনৈতিক বাজার মার্চের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অত্যন্ত চাপের মুখে থাকবে৷ এবং তখন অসংখ্য পরিবর্তন চোখে পড়বে৷ আমার মনে হয় গ্রিসের অর্থনীতি, বাজার এবং সাধারণ মানুষ তা টের পাচ্ছে৷''
সবার মূল লক্ষ্য যে ভাবেই হোক ইউরোকে স্থিতিশীল রাখা৷ একই কথা বললেন স্পেনের অর্থমন্ত্রী এলেনা সালগাদো৷ তিনি বলেন, ‘‘গ্রিসের হাতে সময় রয়েছে এক মাসেরও কম৷ মার্চের মাঝামাঝি সময়ে আমরা এবং ইউরোপীয় কমিশন পুরো পরিস্থিতি যাচাই করে দেখবো৷ আমরা দেখতে চাই সে সময়ে গ্রিস নতুন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কিনা !’’
আরেকটু বিশদভাবে বলতে গিয়ে সুইডেনের অর্থমন্ত্রী আনডের্স বর্গ বলেন, ''আমাদের দৃষ্টিতে যা ধরা পড়েছে তা হল গ্রিক সরকার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা যথেষ্ট নয়৷ আমাদের আরো নির্দিষ্টভাবে জানা প্রয়োজন বাজার স্থিতিশীল রাখতে কোন ধরণের কাজ করছে গ্রিক সরকার৷ তা না হলে এটা শুধু প্রলম্বিত হবে৷ এটা বলা ঠিক হবে না যে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ গ্রিসকে সাহায্য করতে পারবে না৷ তবে তা করতে হবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পর্যবেক্ষণ, নজরদারি এবং গ্রিসের প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক নীতির ওপর ভিত্তি করে৷ ইউরোপ এই মুহূর্তে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তাই বলে আমাদের থেমে থাকলে চলবে না৷ কিন্তু ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সবার আগে গ্রিক সরকারের পক্ষ থেকেই আসতে হবে৷''
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়ম অনুযায়ী কোন দেশের বাজেট ঘাটতির মাত্রা কোন অবস্থাতেই ৩ শতাংশের বেশি হতে পারবে না৷ গ্রিসের বর্তমান বাজেট ঘাটতির পরিমান মোট জাতীয় উৎপাদনের ১২.৭ শতাংশ, জাতীয় আয় ২.৮ শতাংশ এবং রাষ্ট্রীয় ঋণ ১০০ শতাংশ-রও বেশি৷ গ্রিস এতদিন সঠিক পরিসংখ্যানগুলো গোপন রেখেছিল৷
প্রশ্ন কেন এই সংকট ? গ্রিসের বাজেট ঘাটতি ছিল অনেক দিন থেকেই৷ এর মূল কারণ হল অত্যাধিক ব্যয়, বিশেষ করে সরকারের পক্ষ থেকে তা ছিল নজিরহীন৷ আকাশচুম্বী দুর্নীতিরও ছিল ভূমিকা৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হ্যারমান ভ্যান রম্পুই বেশ জোর দিয়েই জানিয়েছেন, গ্রিস আর্থিক সাহায্যের জন্য এখনো আবেদন করেনি৷ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল বলেছেন, গ্রিসকে একা ছেড়ে দেয়া হবে না, প্রয়োজনে সাহায্য করা হবে তবে অবশ্যই তা প্রচলিত নিয়ম কানুনের বহির্ভূত হয়ে নয়৷
ব্রাসেলস সম্মেলনে জানানো হয়, এই সংকট কাটিয়ে উঠতে গ্রিক সরকারকে পুরোপুরি সমর্থন করবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য সদস্য দেশগুলো, এবং এক্ষেত্রে যা প্রয়োজন তা করা হবে৷ ২০১০ সালের জন্য যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে সেটা বাস্তবায়ন করতে গ্রিসকে সাহায্য করতে সদস্য দেশগুলো এগিয়ে আসবে৷
গ্রিসকে জরুরি ভিত্তিতে যা করতে হবে তা হল:
- ইউরোপীয় অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী বাজেট ঘাটতি ৩ শতাংশের নীচে নামিয়ে আনতে হবে এবং তা করতে হবে ২০১২ সালের মধ্যেই৷ ২০০৯ সালে এই ঘাটতি ছিল ১২.৭ শতাংশ৷
- সরকারি চাকরিতে বেতন বাড়ানো যাবে না, বোনাস বাদ যাবে
- প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে থেকে একজনকে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে
- ২০১৫ সালের মধ্যে অবসর গ্রহণের বয়স ৬৫ থেকে ৬৩ করা হবে
- পেট্রল, তামাক, মদ এবং সম্পত্তি ক্রয়ের ক্ষেত্রে কর বাড়ানো হবে৷
কিন্তু সাধারণ গ্রিকরা কি এ সিদ্ধান্তে খুশি ? অবসর গ্রহণ করেছেন গিওর্গস পাপাডোপোলুস৷ বেশ বিরক্তির সঙ্গে তিনি বললেন, ‘‘আমরা যারা অবসর গ্রহণ করেছি আমাদের বেশির ভাগ মানুষকেই মাসে ৭০০ ইউরো দিয়ে খরচ চালাতে হয়৷ এথেন্সের মত বিশাল একটি শহরে এই অর্থ যথেষ্ট নয়৷ এখন যদি এই অর্থ কমানো হয় তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কিছু হতে পারে না৷''
আরেকজন জানালেন, ‘‘গত ৪০ বছর ধরে আমি কষ্ট করে দিন চালাচ্ছি৷ ভগবান নিজেই তা জানেন৷ আমি জানি না আমাদের সরকার বিগত বছরগুলোতে কী ভাবছিল ! আমার আর কিছু বলার নেই৷''
সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করা আর একজন বললেন, ‘‘আমাকে আগেই বলা হয়েছে অবসর ভাতা কমানো হবে৷ যদি সেই অর্থ দিয়ে দেশকে বাঁচানো যায়, দেশকে দেউলিয়াপনার হাত থেকে রক্ষা করা যায় তাহলে সমস্যা নেই৷ কিন্তু কোন অবস্থাতেই আমার অর্জিত অর্থ যেন সরকারী দলের লোকের পকেটে না যায়৷''
ক্ষিপ্ত আরেক ভদ্রলোকের মত, আমি সরকারি চাকরি করতাম৷ এ বছরের শুরুতে আমার আবসর ভাতা ১০ শতাংশ কমানো হয়েছে৷ এটা কোন কথা হল ? এর মানে কী ?
এসব পরিবর্তনে ক্ষিপ্ত গ্রিসের বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়ন৷ বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে বেতন না বাড়ানো এবং অবসর গ্রহণের বয়স কমিয়ে দেয়ার প্রস্তাব - শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যরা মেনে নিতে পারছে না৷
গ্রিসের ঋণের পরমাণ তিনশ বিলিয়ন ইউরো এবং গ্রিক সরকার ধারণা করছে যে আরো প্রায় ৫৩ বিলিয়ন ইউরো হয়তো গ্রিক সরকারকে ঋণ নিতে হতে পারে৷ গ্রিসের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের জরিপ অনুযায়ী ২০০৯ সালের শেষে গ্রিসে বেকারত্বের হার বেড়েছে ১০.৬ শতাংশে৷ সব মিলে পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষ গ্রিসে বেকার৷ ইউরো মুদ্রার দেশগুলোতে প্রায় ১৬ লক্ষ মানুষ এখনো কর্মহীন৷
প্রতিবেদক : মারিনা জোয়ারদার
সম্পাদক: আবদুল্লাহ আল-ফারূক