‘খাড়াই অরণ্য'
২৮ জানুয়ারি ২০১৫২০১৪ সালের সেরা বহুতল ভবন হিসেবে আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে মিলান-এর যে বাড়িটি, তার নাম ‘‘বস্কো ভের্তিকালে'' বা ‘খাড়াই অরণ্য'৷ ভবনটির খাড়া দেওয়ালগুলিতে মোট দুই হেক্টার গাছপালা রোপন করা হয়েছে: পুবে অলিভ গাছ; দক্ষিণে ডালিম৷ মোট ২০ হাজার গাছপালা দিয়ে বাসভবনটির প্রাকৃতিক শীততাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ স্থপতি স্টেফানো বোয়েরি বলেন: ‘‘আজকাল আমাদের অন্য পথে যাওয়া উচিত, বলে আমার ধারণা: টেকসই এবং প্রকৃতিসম্মত ভাবে গড়া উচিত; অরগ্যানিক, জীবন্ত পদার্থ ব্যবহার করে৷''
জুরিপ্রধান ক্রিস্টোফ ইঙ্গেনহোফেন বলেন: ‘‘গাছপালাগুলোর প্রথম কাজ হলো শীততাপ নিয়ন্ত্রণ: যা-তে শীতে তাপ না হারায়, গরমে বাড়ি ঠান্ডা থাকে৷ কাচ অথবা ধাতুর চকচকে, মসৃণ আস্তরণ এবং ছাদের ওপর পিচ ঢালাইয়ের ফলে আমাদের শহরগুলির কেন্দ্রে ‘উত্তাপের দ্বীপ' সৃষ্টি হয়৷''
এই নিয়ে দ্বিতীয়বার একটি আবাসিক ভবন আন্তর্জাতিক বহুতল ভবন পুরস্কারটি পেল৷ একশো মিটারের বেশি উচ্চতার আবাসিক ভবনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে – বিশেষ করে এশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আরব দেশগুলিতে৷ তবে ইউরোপের বড় শহরগুলিতেও তাদের কোনো কমতি নেই৷ ফ্রাংকফুর্টের জার্মান স্থাপত্য মিউজিয়ামের পরিচালক পেটার কাশোলা শ্মাল রেসিডেন্সিয়াল টাওয়ারগুলির জনপ্রিয়তা আরো বাড়বে বলে মনে করেন:
‘‘২০১০ সালেও বহুতল অফিসবাড়ি এই পুরস্কার পেয়েছে৷ তারপর সব কিছু বদলে গেছে৷ তার কারণ হলো এই যে, দুনিয়ায় মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে এবং এই সব মানুষরা শহরে থাকতে চান৷ অথচ শহরগুলো তো আর অনন্ত বেড়ে চলতে পারে না৷ কাজেই মানুষজন শহরের কেন্দ্রে ভিড় করছেন৷ কাজেই এখন ছোট ছোট এলাকার উপর জোর দিতে হবে – অর্থাৎ বাড়ির উচ্চতা বাড়বে৷''
‘যত উঁচু, ততই বেশি দামি'
জার্মানির মানুষ গগনচুম্বী বহুতল ভবন বিশেষ পছন্দ করেন না, কেননা তার ফলে শহরের চেহারা বদলে যায়৷ এছাড়া গত শতাব্দীর ষাটের ও সত্তরের দশকে জার্মানির বিভিন্ন শহরের প্রান্তে এ ধরনের বহুতল আবাসিক ভবনের কলোনি গড়ে উঠেছিল৷ সেগুলো ছিল সস্তার ফ্ল্যাট৷ পেটার বলেন: ‘‘আজ কিন্তু বহুতল ভবনে বাস করাটা একটা মহার্ঘ ব্যাপার৷ সেটা আমরা জার্মানিতেও যেমন দেখতে পাই, তেমন এশিয়াতেও৷ যত উঁচু, ততই বেশি দামি, ততই বেশি অভিজাত৷''
জার্মান স্থাপত্য মিউজিয়ামে মনোনীত সব ক'টি প্রকল্পের মডেল রাখা রয়েছে: ১৭টি দেশে অবস্থিত ২৬টি স্কাইস্ক্র্যাপার৷ তার মধ্যে রেম কোলহাস-এর মতো প্রখ্যাত স্থপতিদের প্রকল্পও পাওয়া যাবে, যেমন কোলহাস-এর সুবিশাল ‘ডে রটারডাম'৷ ভবনটিতে প্রতিদিন পাঁচ হাজার মানুষ আসে যান, কাজ করেন অথবা হয়ত এখানেই বাস করেন৷ এই ভবনটি রটারডামের বন্দর এলাকাকে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করবে, বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে৷ বহুতল ভবন পুরস্কারের একটি বড় শর্ত হলো: পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে খাপ খাওয়া চাই৷
সকলকেই ঝুঁকি নিতে হবে
স্থপতি ও জুরিপ্রধান এবং ২০১২ সালের বিজয়ী ক্রিস্টোফ ইঙ্গেনহোফেন বলেন: ‘‘আমাদের সামনে এখন প্রশ্ন হলো, আমরা বহুতল ভবনের ধারণাটিকে কিভাবে নাগরিক জীবনে ব্যবহার করতে পারি? কীভাবে শহরে সেটাকে কাজে লাগাতে পারি? একটি বহুতল ভবন আরেকটি বহুতল ভবনের সঙ্গে কীভাবে খাপ খায়? রাস্তার সঙ্গে, মেট্রোর সঙ্গে, যানবাহনের সঙ্গে? সেই কারণে আমরা এই ধরনের বহুতল ভবনকে পুরস্কার দিতে চেয়েছি, যাতে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়৷''
একটি ‘সবুজ' বহুতল ভবন, যেখানে মানুষজন, আবার পাখি বা পোকামাকড়ও স্বচ্ছন্দ বোধ করবে৷ বস্কো ভের্তিকালে আসলে একটি খাড়াই অরণ্য – কে জানে দশ বছরে বাড়িটি কেমন দেখতে হবে! ক্রিস্টোফ ইঙ্গেনহোফেন বলেন: ‘‘উঁচু বাড়ি বানাতে গেলে স্বভাবতই অনেক কিছু ব্যবহার করতে হয়, যা বহুদিন ধরে আছে এবং যে সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা আছে৷ কিন্তু আমরা এ-ও দেখতে চাই, সব মিলিয়ে ব্যাপারটা কোনদিকে যাবে, কিসে দাঁড়াবে৷ এই ধরনের বিকাশ ঘটা সম্ভব নয় – বিশেষ করে বড় প্রকল্পে – যদি না বাড়ির মালিক, স্থপতি, প্রযুক্তিবিদ, সকলেই ঝুঁকি নিতে রাজি থাকেন৷'' আর শ্মাল-এর মতে: ‘‘আমাদের মনে হয়, এটি আমাদের গোলার্ধে ‘সবুজ' বহুতল ভবনের একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত৷ এবং আমি নিশ্চিত যে, অনেকেই এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে৷''
ইউরোপের মানুষ সত্যিই স্কাইস্ক্র্যাপারে বাস করতে চাইবেন কিনা, তা জানার আজ কোনো উপায় নেই৷ তবে দেখা যাচ্ছে, প্রেরণার কোনো কমতি নেই৷