‘কী বই পড়ছেন – আজকাল?’
৭ ডিসেম্বর ২০১৪বলতে কি, যেন বই পড়েই মানুষ হলাম৷ একটা নয়, তিনটে ভাষায়৷ শুরু হয়েছিল জল পড়ে পাতা নড়ে দিয়ে৷ ন'খানা বর্ণপরিচয় তার আগে চিবিয়ে খেয়েছিলাম না পরে, সেটা আজ বলতে পারব না৷ সি-এ-টি ক্যাট, বি-এ-টি ব্যাট, ওঃ নাঃ, তার আগেও তো ছিল এ ফর অ্যাপল, বোধহয় ম্যাকমিলানের, সে যে কী স্বর্গীয় আপেল, তার যে কি শোভা!
তারপর কবে যেন একটা ছোটদের রবিন হুড হাতে এলো, পাঠ্য বই হিসেবে৷ তা-তে লিটল জন কিংবা শেরউড ফরেস্ট-কে যত না মনে আছে, তার চেয়ে বেশি মনে আছে ইংল্যান্ডের গ্রামের একটা ল্যান্ডস্কেপ: সে যে কী অসাধারণ ডাইনি বুড়ির বিস্কুট দিয়ে তৈরি কুটিরের মতো বাড়ি; কিরকম পেল্লাই মোটা মোটা গরু ঘুরে বেড়াচ্ছে – কিন্তু কোথাও গোবরের তাল পড়ে নেই৷ সত্যিই তো, ইংল্যান্ডে তো কেউ ঘুঁটে দেয় না...
বাংলা থেকে ইংরিজি বেলাইনে চলে যাওয়াটা আমার আগে বঙ্কিম এবং মাইকেলের মতো মহাত্মারা করে গেছেন৷ স্বয়ং রবি ঠাকুর তাঁর একটি নমস্কারে প্রভুর অনুবাদ করেছেন ‘‘ওয়ান স্যালুটেশন টু দ্য মাই লর্ড'' – এবং সেজন্য নোবেল প্রাইজও পেয়েছেন৷ অথচ মা কিন্তু আমাদের থাবড়ে থাবড়ে রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন; পরে অবন ঠাকুরের বুড়ো আঙলা আর নালক শুনেছি মা-র কাছে, গরমের দুপুরের আধঘুমে৷ বাংলাটা ছিল রক্ত-মাংস, ইংরিজিটা জামাকাপড়, আজও আছে৷
ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে চলে যাই সেই আমলে, যখন মা বেথুন কলেজ লাইব্রেরি থেকে ইস্পাত, রংরুট, কাল তুমি আলেয়া-র মতো মোটা মোটা উপন্যাস আনছেন আর আমি আর আমার বড়দি সেগুলো গোগ্রাসে পড়ছি – প্রাপ্তবয়স্ক না হয়েই৷ তার পরপরই বাবা রবি ঠাকুরের উপর তাঁর বই লিখতে শুরু করলেন: তেতলার কাঁচের আলমারি থেকে বড়মামি-মার বহুমূল্য রবীন্দ্র রচনাবলী একতলায় নামতে শুরু করল, খণ্ড বাই খণ্ড৷ আমার রাবীন্দ্রিক দীক্ষা হলো: তখন আমি ক্লাস সেভেনে৷
সেখান থেকে সোজা প্রমোশন বড়মামার বইয়ের তাকে – সে-ও তেতলায় – নানা ইংরিজি নভেল: পি জি উডহাউস থেকে শুরু করে আগাথা ক্রিস্টি, সঙ্গে উইলিয়াম সমারসেট মম কি এ জে ক্রনিন৷ সেগুলো ঊর্ধশ্বাসে পড়ে ফেলতে না ফেলতে বাবার পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা কড়কড়ে দু'টাকার নোট ‘‘ধার নিয়ে'' গোল পার্কের কাছে এক বিহারির স্টল থেকে ফরাসি লেখক আলবেয়ার কামু-র সুবিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য ফল' কিনে ফেললাম – অবশ্যই ইংরিজি অনুবাদে: জাস্টিন ও'ব্রায়েন-এর কি?
সেখান থেকে ইংরিজিতে বিএ-এমএ তো আর খুব বেশি পথ নয়৷ তার পর আবার জার্মান প্রবাস, জার্মান ভাষা শিক্ষা, কবি রিলকে, কথাসাহিত্যিক কাফকা-কে নতুন করে আবিষ্কার....কিন্তু প্রবাসে এসে দেখি, স্বদেশ আমার বই সেজে বুকশেল্ফের একটা কোণা আলো করে রেখেছে৷ তারাশঙ্করের হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, কবি, আরোগ্য নিকেতন, গণদেবতা, ধাত্রীদেবতা; শরৎ রচনাবলী (এক খণ্ডে); বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড, সমগ্র উপন্যাস)৷ অন্যদের আর নাম করলাম না – কিন্তু ডাউন টু অতীন ব্যানার্জ্জি অথবা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, ঝুলিতে সবাই ছিলেন এবং আছেন৷
নতুন বই? তা-ও পড়া হয়, কিন্তু পুরনো বইগুলো যেন আমার হোমিওপ্যাথির বাক্সের মতো: এরাই আমার পালসেটিলা, নাক্সভমিকা৷ এই তো, গতকাল একটা ভাইরাল ইনফেকশন হয়ে কোঁকাচ্ছি৷ শেষে বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী খুলে দীনেশ চন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গে' তার ঐতিহাসিক দিকটা চেক করে নিলাম৷ রোগ না সারলেও, মন ভালো হয়ে গেল...