1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারত সফরে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট

অনিল চট্টোপাধ্যায় নতুন দিল্লি
২ মে ২০১৭

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ভারতে পা রাখার আগে-পরে যে ধরণের মন্তব্য করেছেন, তাতে বিভিন্ন স্পর্শকাতর ইস্যুতে ভারতকে ঠেলে দিয়েছে কূটনৈতিক অস্বস্তির মধ্যে৷ প্রশ্ন উঠেছে, এর পেছনে কি আর্মেনিয়ান গণহত্যার অপরাধবোধ কাজ করছে?

https://p.dw.com/p/2cEMA
Präsident Erdogan besucht Indien
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/M. Swarup

এপ্রিলের গণভোটে নিজের হাত শক্ত করে তুরস্কের নতুন প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান নতুন ইসলামিক শক্তিরুপে দিল্লিতে পা রাখার আগে এবং পরে যেভাবে ভারতের স্পর্শকাতর ইস্যুগুলি নিয়ে একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করে গেছেন, তাতে ভারতের কূটনৈতিক মহলের অনেকে তাঁর মধ্যে পাকিস্তানের হয়ে দূতের ভূমিকা দেখতে পেয়েছেন৷ দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা বাণিজ্যের চেয়ে তুর্কি প্রেসিডেন্টের কাছে বেশি গুরুত্বপূ্র্ণ মনে হয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর বিরোধ, পরমাণু উপকরণ সরবরাহকারী গ্রুপে (এনএসজি) ভারতের সদস্যপদে আপত্তি না থাকলেও এনএসজিতে পাকিস্তানের সদস্যপদের প্রতি তাঁর জোর সমর্থন৷ যদিও ভারতের যুক্তি পরমাণু অস্ত্রের প্রসার রোধে পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের রেকর্ড অনেক ভালো৷ সীমান্ত পারের সন্ত্রাসে পাকিস্তানের মদত দেবার অভিযোগ সম্পর্কে এর্দোয়ান একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি৷ অবশ্য এটা কারোর অজানা নয় যে, তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ তথা পাকিস্তানের বিশেষ বন্ধু৷ কিন্তু তাই বলে ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভারতের অতিথি হিসেবে এইভাবে পাকিস্তানের দূতগিরি করাটা কূটনৈতিক প্রোটোকল হিসেবে অনেকের কাছে দৃষ্টিকটু লেগেছে বৈকি৷

কাশ্মীর সম্পর্কে কাটা ঘাঁয়ে নুনের ছিঁটা দিয়ে এর্দোয়ান বলেছেন, আজ কাশ্মীরের যে পরিস্থিতি তাতে এটা আর চলতে দেওয়া যায় না৷ আশু সমাধানের জন্য অবিলম্বে বহুপাক্ষিক আলোচনা শুরু করা দরকার৷ তাতে তুরস্ক মধ্যস্থতা করতে আগ্রহী৷ ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকেও তিনি সরাসরি এ কথা তুলেছেন৷

অতিথির মর্যাদা রাখতে দিল্লি বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও অস্বস্তি ঢেকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, কাশ্মীর সম্পর্কে ভারতের নীতি কী৷ বলেছে, কাশ্মীর ইস্যু ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বিষয়৷ এতে তৃতীয় পক্ষের স্থান নেই এবং থাকবে না৷ গোটা কাশ্মীর ভারতের অচ্ছেদ্য অঙ্গ৷ এর আগে একই বার্তা দেওয়া হয়েছিল ওয়াশিংটনে ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারের কাছেও৷

সন্ত্রাস দমনে উভয়দেশ অবশ্য একমত৷এর্দোয়ানের ‘দ্বিচারিতা’ নিয়েও কথা উঠেছে৷ অতি সম্প্রতি ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যে সুকমায় মাওবাদী জঙ্গি হামলায় ২৫ জন আধা-সামরিক বাহিনীর জওয়ান নিহত হওয়ার ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন, কিন্তু পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সীমান্ত পারের জঙ্গি হানায় নিহত ভারতীয় সেনাদের বিষয়ে তিনি নীরব৷

দিল্লি সফরে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মনে কি সে দেশের আর্মেনিয়ান গণহত্যার অপরাধবোধ কাজ করছে? ডয়চে ভেলের পক্ষে প্রশ্নটা করা হয় রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরিকে৷ উত্তরে উনি বললেন, ‘‘অপরাধবোধ তাঁর থাকতেই পারে এবং সেই প্রসঙ্গটা ওঠাও স্বাভাবিক৷ সেটা শুধু আর্মেনিয়ান গণহত্যা নয়, হালে তাঁর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের যে চেষ্টা করা হয় এবং সেই বিদ্রোহ দমনে তাঁর সরকার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটাও কিন্তু পুরোপুরি অগণতান্ত্রিক এবং অগ্রহণযোগ্য৷  হাজার হাজার মানুষকে জেলে পোরা হয়৷ দেড় লাখের মতো সরকারি কর্মচারিকে হয় সাসপেন্ড কিংবা ছাঁটাই করা হয়৷ দেড়শ'র মতো মিডিয়াহাউজ বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ রেহাই পায়নি সাংবাদিকরাও৷ প্রায় ২০০-র মতো সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এখনও দমন-পীড়ন শেষ হয়নি৷’’ এর্দোয়ান সরকারের যুক্তি, এদের গাড়িতে অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে, এরা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মূল চক্রী গুলেনিস্ট সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত৷ আর্মেনিয়ান গণহত্যার পাশাপাশি এটাও তুর্কি প্রেসিডেন্টের মনে থাকতে পারে বলে ডয়চে ভেলেকে বললেন অধ্যাপক বসু রায়চৌধুরি৷

দিল্লিতে পাকিস্তানের প্রতি তিনি তাঁর পক্ষপাতিত্ব চেপে রাখেননি৷ এশিয়াকে ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত করতে চীনের সড়ক নীতিতে পাকিস্তানের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে বলে তাতে তিনি গভীর আগ্রহ প্রকাশ করলেন৷ কিন্তু ভেবে দেখলেন না ভারতের কাছে সেটা কতটা গ্রহণযোগ্য৷ তার কারণ, এই মহাসড়ক যাবে ভারত-চীন বিতর্কিত এলাকা আকসাই-চীন অঞ্চলের মধ্য দিয়ে৷ একইভাবে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর তৈরি করা ভারতের কাছে বলা বাহুল্য যে গ্রহণীয় নয়, সেটাতেও তিনি আমল দিলেন না৷

মোট কথা, সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এর্দোয়ানের দিল্লি সফর খুব আশাব্যঞ্জক নয়৷ দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্যে সহযোগিতার কিছু সুযোগ থাকলেও কূটনৈতিক দিক থেকে সদর্থক বলা যায় না৷ ডয়চে ভেলেকে এমনটাই বললেন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরি৷

অন্যদিকে, কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের ইসলামিক কনফারেন্স সংগঠনের (ওআইসি) প্রস্তাবের নিরিখে তুরস্কে কুর্দিস্তান আন্দোলন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তুর্কী প্রেসিডেন্ট বলেন, কাশ্মীর ও স্বাধীন কুর্দিস্তান দুটি আলাদা বিষয়৷ সরকার কুর্দদের বিরোধি নয়৷ বিরোধী কুর্দ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলির৷

উল্লেখ্য, তুর্কী প্রেসিডেন্টের দিল্লি আসার কয়েকদিন আগে ভারত সফরে এসেছিলেন, সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট৷ ভারতের সঙ্গে সাইপ্রাসের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব৷ কিন্তু তুরস্কের সঙ্গে বৈরিতা বহু বছরের৷ সাইপ্রাস স্বাধীন হয় ষাটের দশকে৷ কিন্তু উত্তর সাইপ্রাস আজও তুরস্কের দখলে৷ গত এপ্রিল মাসে ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি যান আর্মেনিয়া সফরে৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন তুরস্কে ১৫ লাখ আর্মেনিয়ান গণহত্যার শিকার হয়৷ সেই স্মৃতিস্থলে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করে উপ-রাষ্ট্রপতি মন্তব্য করেন, এই গণহত্যা মানব ইতিহাসের এক অবর্ণনীয় ট্র্যাজেডি৷ বিংশ শতাব্দিতে মানুষের হাতে মানুষের প্রথম গণহত্যা৷ এর্দোয়ানের কানে সম্ভবত সেই মন্তব্যের রেশ কাটেনি৷ যদিও তুর্কিরা মনে করে, সেটা গণহত্যা ছিল না, ছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা৷ মুসলিম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে৷ তবে ইতিহাস বলে অন্য কথা৷ এই পরিস্থিতিতে তুরস্ক, সাইপ্রাস ও আর্মেনিয়ার মধ্যে একটা কঠিন কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হবে দিল্লিকে৷