আফ্রিকার আলবিনোরা: ‘লুকিও না!’
আলবিনো মানে, ত্বকে রঞ্জক পদার্থের অভাবে জন্ম থেকেই যাদের গায়ের রং সাদা, চুল সোনালি ও চোখ কটা৷ বিপুল কুসংস্কার ঠেলে এবার রুখে দাঁড়াচ্ছেন আফ্রিকার আলবিনোরা৷
সাদা কি সুন্দর নয়?
থান্ডো হোপা দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজীবী, বয়স পঁচিশের কাছাকাছি৷ সারা জীবন ধরে সানব্লক, লম্বা জামাকাপড় ব্যবহার করে সূর্যালোক থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে আসছেন৷ আজ তিনি আফ্রিকার আলবিনোদের বিরুদ্ধে বৈষম্য দূর করার জন্য আন্দোলনে নেমেছেন – এমনকি ফ্যাশন মডেল হিসেবেও৷
ফ্যাশন মডেল
চার বছর আগে এক শপিং সেন্টারে থান্ডো হোপাকে আবিষ্কার করেন দক্ষিণ আফ্রিকার ডিজাইনার গ্যার্ট-ইওহান কোয়েটসে (ছবিতে হোপার পিছনে)৷ আজ হোপা দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে পরিচিত মডেলদের মধ্যে একজন৷ বহু ফ্যাশন ম্যাগাজিনে তাঁর ছবি ছাপা হয়েছে৷ ২০১৩ সালে ফর্বস লাইফ আফ্রিকার প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদে ছিলেন থান্ডো হোপা৷
ভুল ভাঙা
আলবিনোরা মানুষ নয়, বরং ভূত – বলে অনেক আফ্রিকাবাসীর ধারণা৷ এমনকি তাদের শরীরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাকি সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্য এনে দিতে পারে৷ অথচ অ্যালবিনিজম একটা জিন সংক্রান্ত ব্যাধি; এর ফলে ত্বকে কোনো রঞ্জক পদার্থ থাকে না৷ সারা বিশ্বে প্রতি ২০ হাজার মানুষের মধ্যে একজন মানুষের এই ব্যাধি থাকে৷ পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রায়ই আলবিনোদের দেখা পাওয়া যায়৷
মারাত্মক কুসংস্কার
আফ্রিকাতে আলবিনোদের মেরে তাদের লাশ ওঝা আর গুণিনদের কাছে বেচে দেওয়া হয়৷ ওঝা-গুণিনরা নাকি সেই লাশের বিভিন্ন অংশ দিয়ে জাদু করে৷ জাতিসংঘের বিবরণ অনুযায়ী, একজন আলবিনোর লাশ কালোবাজারে প্রায় সত্তর হাজার ডলার মূল্যে বিক্রি হয়, শুধুমাত্র একটা পায়ের দাম হতে পারে দু’হাজার ডলার৷ তানজানিয়া অ-রেজিস্ট্রিকৃত ওঝাদের নিষিদ্ধ করেছে – প্রতিবেশী দেশ মালাউয়ি যা করেনি৷
প্রাণভয়
ডরোথি মাউসেন-এর বাস মালাউয়ি-র মাচিঙ্গা প্রদেশে৷ তিনি বলেন, তিনি কখনও নিরাপদ বোধ করেন না৷ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে প্রায় দশ হাজার আলবিনো-র বাস৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতি অনুযায়ী গত দেড় বছরে মালাউয়িতে ১৮ জন আলবিনো খুন হয়েছেন৷ মালাউয়ি পুলিশের কাছে আলবিনোদের উপর ষাটের বেশি সহিংস আক্রমণের খবর আছে৷
২৪ ঘণ্টা সুরক্ষা
রজিক জাফালি তাঁর ছেলেদের চোখের আড়াল করেন না৷ তিন বছরের কাসিমকে বাঁচানোর জন্য তিনি তাঁর পেশা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছেন৷ মালাউয়িরা শান্তিপূর্ণ বলে খ্যাত, কিন্তু আলবিনোদের উপর সাম্প্রতিক আক্রমণের পর প্রেসিডেন্ট পিটার মুথারিক বলেছেন, তিনি লজ্জা বোধ করেন৷
মান্ডেলার জন্য গান
সলিফ কাইটা আফ্রিকান পপ মিউজিকের একজন স্টার বলা চলে৷ তাঁর জন্ম মালিতে; তিনি জানেন আফ্রিকায় আলবিনো হওয়াটা কতোবড়ো বিড়ম্বনা৷ কাইটা বাস উঠিয়ে প্যারিসে চলে যান ১৯৮৪ সালে৷ ১৯৮৮ সালের ১১ই জুন ছিল নেলসন মান্ডেলার সত্তরতম জন্মদিন; সেই উপলক্ষ্যে লন্ডনের ওয়েম্বলে স্টেডিয়ামে একটি গানের জলসার আয়োজন করা হয়৷ সেই জলসায় গান গেয়ে বিখ্যাত হয়ে যান কাইটা৷ মান্ডেলা তখনও কারাবাসে৷
খুঁত নয়, বৈশিষ্ট্য
কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে ২০১৫ সালের একটি ফেস্টিভাল থেকে এক নতুন ধারার সৃষ্টি হয়৷ কিনশাসার তিনদিনব্যাপী এই উৎসবটি ছিল প্রধানত আলবিনোদের জন্য৷ আজ বহু আফ্রিকান অনলাইনে তাদের কাহিনি শোনাচ্ছেন, যেমন টুইটারে #অ্যালবিনিজমইজজাস্টএকলর, এই হ্যাশট্যাগে৷
সূর্যালোক এড়িয়ে চলতে হয়
আলবিনো মানে শুধু গায়ের রং সাদা নয়৷ যাদের ত্বকে মেলানিন নামের পিগমেন্টটি নেই, তাদের পক্ষে বেশিক্ষণ রোদ্দুরে থাকা উচিত নয়, কেননা তাহলে স্কিন ক্যানসার হবার আশঙ্কা থাকে৷ চোখে মেলানিন না থাকার ফলে দেখার অসুবিধা হতে পারে৷ আলবিনোদের পক্ষে সূর্যালোক থেকে বাঁচা অতি জরুরি৷
কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ফুটবল
সূর্য যখন তানজানিয়ার রাজধানী দার-এস-সালাম-এর উপর দিয়ে ঢলে, ঠিক তখনই শুরু হয় সইদ সেরেমানি ও তাঁর ‘আলবিনো ইউনাইটেড’ দলের ট্রেনিং৷ ছেট্ট, ধুলোভরা মাঠ – তাতে কী হয়েছে, আফ্রিকার আলবিনো-রাও দিদিয়ের দ্রোগবা কিংবা পিয়ের-এমেরিক ওবামেইয়াং-এর মতো ফুটবলার হবার স্বপ্ন দেখছেন৷