আওয়ামী লীগ নেতার গুলিতে সাংবাদিকের মৃত্যু
৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭আব্দুল হাকিম শিমুল ছিলেন দৈনিক সমকালের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি৷ শুক্রবার তাঁকে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে ঢাকায় আনার পথে তিনি মারা যান৷ তাঁর মরদেহ বাড়িতে নেয়া হলে মরদেহ দেখে শিমুলের নানীও মারা যান৷
জানা গেছে, শাহজাদপুরের দিলরুবা বাস টার্মিনাল থেকে উপজেলা সদর পর্যন্ত রাস্তার কাজ নিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে কালিবাড়ি এলাকায় শাহজাদপুর পৌরসভার মেয়র হালিমুল হক মিরু’র ছোট ভাই হাসিবুল ইসলাম পিন্টু পৌর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ভিপি রহিমের শালা ছাত্রনেতা বিজয়কে বেধড়ক মারপিট করে হাত-পা ভেঙে দেয়৷ এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে দলের কর্মী-সমর্থক ও তার মহল্লা কান্দাপাড়ার লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে বাস টার্মিনাল এলাকায় গিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে৷ অবরোধকারীদের একটি অংশ ক্ষিপ্ত হয়ে মনিরামপুর এলাকায় পৌর মেয়রের বাড়ি ঘিরে ফেলে ইট-পাটকেল মারতে থাকে৷ স্থানীয়রা জানান, এ সময় মেয়র নিজের শটগান দিয়ে গুলি করলে সাংবাদিক শিমুলের মাথা ও মুখে গুলি লাগে৷ গুরুতর আহত হন শিমুল৷ প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানিয়েছে, মেয়রের শটগান থেকেই গুলি ছোঁড়া হয়েছিল৷
গুলিতে আহত শিমুলকে প্রথমে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজে নেয়া হয়েছিল৷ সেখানকার নিউরো সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. সুশান্ত কুমার সাংবাদিকদের জানান, শিমুলের মাথার ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছিল৷ অচেতন অবস্থায় আইসিইউতে রাখার পর উন্নত চিকিত্সার জন্য শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তাঁকে ঢাকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ নিউরো সাইন্স হাসপাতালে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়৷
দৈনিক সমকালের সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া প্রতিনিধি কল্যাণ ভৌমিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ চলাকালে সেখানে ছবি তুলতে গিয়েছিলেন শিমুল৷ এর মধ্যেই তাঁর মাথায় গুলি লাগে৷ দুপুরে তাঁর মৃত্যু হওয়ার পর লাশ পরিবারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়৷ সেখানে নাতির লাশ দেখে স্ট্রোক করেন আশিতিপর বৃদ্ধ নানী৷ তখনই তাঁর মৃত্যু হয়৷’’
শিমুলের লাশ সিরাজগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে৷ শনিবার দুপুরে দ্বিতীয় দফা জানাযার পর পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে৷
সাংবাদিক আব্দুল হাকিম শিমুলের ভাই মকবুল হোসেন স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, মেয়রের ভাই পিন্টু শিমুলের মাথায় গুলি করেছিল৷ মকবুল হোসেনের ভাষায়, ‘‘ঢাকায় যাওয়ার পথে বেলা ১টার দিকে টাঙ্গাইলে তাঁর (শিমুল) মৃত্যু হয়৷ সংঘর্ষের সময় গুলিবর্ষণের ছবি তোলার কারণেই মেয়রের ভাই পিন্টু তার ভাই শিমুলের মাথায় গুলি করে৷ এ ব্যাপারে মামা আবদুল মজিদ মন্ডল শাজাজাদপুর থানায় মামলা করেছেন৷’’
পুলিশ শুক্রবার পৌর মেয়রের দুই ভাই হাসিবুল ইসলাম পিন্টু ও মিন্টুকে গ্রেফতার করেছে৷ মেয়রের লাইসেন্সকৃত শর্টগানটিও জব্দ করেছে৷ শনিবার শাহজাদপুরে অর্ধদিবস হরতাল ডেকেছে ছাত্রলীগ৷
এদিকে সিরাজগঞ্জের এমপি ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘ইতিমধ্যে কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছে৷ অপরাধী যে-ই হোক তাদের গ্রেফতার করার জন্য আমি এসপিকে বলে দিয়েছি৷ এখানে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না৷ সে দলের লোক হলেও কোনো ছাড় নেই৷ এ ব্যাপারে আমরা কঠোর অবস্থান নিয়েছি৷ পাশাপাশি আহত সাংবাদিকের চিকিত্সার জন্য আমি সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলাম, কিন্তু তাকে বাঁচানো যায়নি৷’’
শাহজাদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রেজাউল বলেন, ইতিমধ্যে মেয়র মিরু, তার ভাই পিন্টু ও মিন্টুসহ ১১ জনের নাম উল্লেখ করার পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা পাঁচ-সাতজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে৷ এদিকে শুক্রবার সকালে মেয়রের বিরুদ্ধে পৌর শহরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন ভিপি রহিম ও ছাত্রলীগ নেতা বিজয়ের কর্মী-সমর্থকরা৷ পরে তারা শাহজাদপুর উপজেলায় শনিবার অর্ধদিবস হরতাল আহ্বান করেন৷
উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ কাজল বলেন, ছাত্রলীগ নেতা বিজয়কে মারধর ও মেয়রের গুলি ছোড়ার প্রতিবাদে শনিবার উপজেলায় অর্ধদিবস হরতাল আহবান করা হয়েছে৷
দৈনিক সমকালের সহযোগী সম্পাদক সবুজ ইউনুছ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা অবশ্যই নিহত শিমুলের পরিবারের পাশে দাঁড়াব৷ তার পরিবারকে আর্থিক ও মানষিক সব ধরনের সহযোগিতাই করব৷ পাশাপাশি সরকারের প্রতি আনুরোধ করব, তার দু’টি সন্তান আছে, একটি সাধারণ পরিবারের মানুষ ছিলেন শিমুল৷ তার পরিবারের দিকে সরকার যেন অবশ্যই নজর দেয় এবং এই ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে৷ আর তার সন্তানরা যেন সমাজের অন্য ছেলে-মেয়েদের মতো বড় হতে পারে সে ব্যবস্থা করে৷’’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব ওমর ফারুক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা এই হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা জানাই৷ আমি এটাকে বলব এক্সিডেন্টালি মার্ডার৷ কারণ তাকে টার্গেট করে তো খুন করা হয়নি৷ কিন্তু টার্গেট করে যেসব সাংবাদিক খুন করা হয়েছে সেসব হত্যারই বিচার আমরা পাইনি৷ এক্ষেত্রে আমি আশা করব সরকার এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে৷ আর আমরা সাংবাদিক নেতা হিসেবে অবশ্যই নিহত শিমুলের পরিবারের পাশে দাঁড়াব এবং সহযোগিতা করব৷’’